পর্ব: ৫ গল্প: হতভাগা লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৫
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

রায়হান আর নাদিয়ার জীবনে এক নতুন সকাল। 'হতভাগা' নামের যে সংগঠনের স্বপ্ন তারা বুনেছিল, তা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। শহরের উপকণ্ঠে একটি পুরনো বাড়ি সংস্কার করে চালু হচ্ছে সেই আশ্রয়কেন্দ্র—সেই আশ্রয়, যেখানে মেয়েরা নির্যাতনের ইতিহাস নয়, নিজের ভবিষ্যৎ গড়বে।

নাম—“হতভাগা আশ্রয়ণ কেন্দ্র”



সকাল ৯টা। ঘরের প্রতিটি কোণে ব্যস্ততা। রায়হান অফিস থেকে কিছু কর্মী নিয়ে এসেছে, যারা অফিসিয়াল ফাইল তৈরির কাজ করছে। নাদিয়া প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখছে—শিশুদের ঘর, কাউন্সেলিং রুম, রান্নাঘর সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না।

একটা ছোট ঘরে তিনটি খাট বসানো হয়েছে। বালিশের পাশে রাখা কিছু বই। দেয়ালে লেখা—


এই লাইনটা নাদিয়া নিজেই লিখেছে।

তখনই একজন নারী আসেন দরজায়। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মুখে চাপা কান্নার ছাপ। কোলে ছোট্ট এক মেয়ে।

— “আপারা, আমার নাম সীমা। আমি পালিয়ে এসেছি আমার স্বামীর হাত থেকে। আমাকে কি একটু থাকতে দেবেন এখানে?”

নাদিয়া হাসিমুখে বলে,
— “আপনার বাড়ি এখন এইখানেই। আর কখনো আপনাকে পালাতে হবে না।”

সীমা চোখ মুছে বলে,
— “আপার গল্পটা পত্রিকায় পড়েছিলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম, যদি কোনোদিন বাঁচতে চাই, তাহলে আপনাদের কাছেই আসব।”

নাদিয়া ওর হাত ধরে বলে,
— “আপনার বাঁচা আজই শুরু হলো।”



এই সময়ে একদিন হঠাৎ খবর আসে—শাহিনুর বেগম গুরুতর অসুস্থ। স্ট্রোক হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি।

রায়হান খবর শুনে স্থির হয়ে যায়।

তিন বছর হয়ে গেল—মা আর ছেলে কথা বলেনি। নাদিয়ার প্রসঙ্গে যে কঠিন কথা বলা হয়েছিল, সেটা এখনো রায়হানের বুকে শেকড় গেড়ে আছে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক কি চাইলেই মুছে ফেলা যায়?

নাদিয়া বলে,
— “তোমার উচিত, মায়ের পাশে যাওয়া।”

রায়হান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে,
— “সে মা আমার স্ত্রীকে কলঙ্কিনী বলেছিল।”
— “হয়তো এখন তার বুকেও তীব্র অনুশোচনা আছে। এখন সময় সম্পর্ক জোড়ার, ছিঁড়বার নয়।”

রায়হান চুপচাপ চলে যায় হাসপাতালে। কেবিনে ঢুকে দেখে, বৃদ্ধা মা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। চোখের কোণ ভেজা। ডাক্তার বলে দিয়েছেন—চাপ খুব কম, যেকোনো সময় খারাপ কিছু হতে পারে।

রায়হান ধীরে ধীরে মায়ের পাশে বসে। হাতটা ধরে।
— “মা, আমি এসেছি।”

শাহিনুর বেগম চোখ মেলে তাকায়। কান্না জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বলেন,
— “বাবা, আমি ভুল করেছি। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। তোদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তোর বউকে কখনো ভুলতে পারিনি... প্রতিদিন আল্লাহর কাছে মাফ চাই।”
— “মা, আল্লাহ চাইলে সব মাফ হয়। তুমি শুধু বাঁচো। আমরা আবার একসাথে থাকব।”

এই প্রথম বার রায়হান নিজের চোখে পানি দেখে। সেই মা, যে কঠোর ছিলেন, আজ এক গুচ্ছ অনুশোচনায় নরম হয়ে গেছেন।



‘হতভাগা আশ্রয়ণ কেন্দ্র’ দিনে দিনে একটি আলোচিত প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কাভার করে। এনজিও, সরকারি প্রতিষ্ঠানও সাহায্যের হাত বাড়ায়।

কিন্তু, নতুন আলো যতই জ্বলে, পুরনো অন্ধকার ততই ছায়া ফেলে।

একদিন খবর আসে—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক মিথ্যে গল্প ছড়ানো হচ্ছে। কেউ বলছে, “নাদিয়া নিজের খ্যাতি আর টাকা কামানোর জন্য এসব করছে।”
কেউ বলছে, “ওর চরিত্র এখনো সন্দেহজনক, ওর বাচ্চার আসল বাপ কে তা আজও কেউ জানে না।”

নাদিয়া সব শুনেও চুপ থাকে। কিন্তু সীমা এসে একদিন বলে,
— “আপা, আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে সহ্য হয় না।”

নাদিয়া বলে,
— “তাদের কথা শোনার দরকার নেই। তারা কোনোদিন আমাদের জায়গায় ছিল না, থাকবে না।”

রায়হান পাশে এসে বলে,
— “জানো, তুমি যত ওপরে উঠছো, ততই নিচু লোকদের আওয়াজ বাড়বে।”

নাদিয়া মাথা নিচু করে বলে,
— “আমার শুধু ভয় হয়, আমার ছেলে একদিন এই কথাগুলো শুনে কি ভাববে?”

রায়হান ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
— “সে গর্ব করবে, মা হিসেবে একজন যোদ্ধা পেয়েছে বলে।”



‘হতভাগা’ সংগঠন একদিন আয়োজন করে একটি বড় অনুষ্ঠান—“সাহসিনী উৎসব”। যেসব নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের সম্মাননা দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা নাদিয়া। স্টেজে উঠে চুপ করে দাঁড়ায়। পুরো মিলনায়তন স্তব্ধ। কেউ কেউ মোবাইল দিয়ে ভিডিও করে, কেউ চোখ মুছে।

নাদিয়া বলে—

“আমি একদিন গর্ভবতী হয়েছিলাম, যখন সমাজ বলেছিল, এই সন্তান পাপের ফল।
আমি ঘরে ফিরিনি, রাস্তায় ফিরিনি—আমি নিজের অস্তিত্বে ফিরেছি।

আমার সন্তান আজ স্কুলে যায়। হাসে, দৌড়ায়। তাকে দেখে কেউ বলে না, সে ‘পাপের ফল’।
কারণ সে আমার মতো একটি মেয়েকে নতুন জীবন দিয়েছে।

আমি চাই, এই পৃথিবীতে আর কোনো মেয়েকে ‘হতভাগা’ না শুনতে হয়।
তাকে বলা হোক—‘তুমি একা নও।’”

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তালি দেয়। সেদিন ‘হতভাগা’ নামটা আর একটি অপবাদ নয়, সেটি এক উৎসাহের প্রতীক



ঠিক যখন সব কিছু গুছিয়ে আসছিল, একদিন সীমা চিৎকার করে ছোটে—
— “আপা! তানিয়ার খবর পেয়েছি। ওকে ওর স্বামী খুন করে ফেলেছে!”

তানিয়া ছিল ‘হতভাগা’ কেন্দ্রে প্রথম দিককার বাসিন্দা। সে নিজের সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। পরে নিজেই গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, সমাজের চাপে।

নাদিয়া খবর শুনে বসে পড়েন মাটিতে।

— “আমি ওকে রক্ষা করতে পারিনি… আমি ব্যর্থ...”

রায়হান পাশে বসে বলে,
— “তুমি একা নও। আমাদের লড়াইটা এখনো অনেক বাকি। আমাদের আর একটা তানিয়াকে হারাতে দেওয়া চলবে না।”



একদিন সকালে, রায়হান নাদিয়াকে বলে,
— “তোমার জীবনের গল্পটা একটা সিনেমা বানাতে চাই এক পরিচালক। রাজি হবে?”

নাদিয়া চুপ করে। বলে,
— “গল্পটা আমার না। এটা হাজার হাজার মেয়ের। যদি ওদের কণ্ঠ হয়, তাহলে হ্যাঁ।”

ফেব্রুয়ারি মাসে ‘হতভাগা’ নামে সিনেমা মুক্তি পায়। প্রচুর দর্শক দেখে, ভালোবাসে।

নাদিয়ার ছেলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে বলে,
— “মা, সবাই বলে তুমি হিরো... তুমি কি হিরো?”

নাদিয়া হেসে বলে,
— “আমি মা, আর তুই আমার হিরো।”

ছেলেটা বলে,
— “তাহলে আমি একদিন তোমার মতো হবো।”



হতভাগা নামের মেয়েটি এখন শতভাগ সাহসের প্রতীক। তার গল্পের শুরু যেখানে “পাপ” বলে ডাকা হয়েছিল, সেইখান থেকেই সে প্রমাণ করেছে—“পাপ নয়, সে প্রত্যাঘাত।”


চলবে…
পর্ব: ৫
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



0 Post a Comment:

Post a Comment