গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৪
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেছে। আদালতের রায় ঘোষণার পর কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। তিনজন অপরাধী এখন কারাগারে। সমাজের চোখে নাদিয়া এখন এক ‘বীর নারী’। কিন্তু নিজের মনে? প্রতিদিন সকালেই প্রশ্ন করে সে নিজেকে—"আমি কি আসলেই ঠিক আছি?"
ছোট্ট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে বারান্দায় বসে। কোকিলের ডাক শোনে। হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচল দুলে ওঠে। একটুকরো শান্তি, কিন্তু অস্থির এক হৃদয়ের মাঝে।
রায়হান সেই সকালে অফিস গেছে। এখন সে একটি এনজিওতে কাজ করে, যেখানে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ হয়। নাদিয়া নিজেও মাঝে মাঝে অংশ নেয় তাদের প্রজেক্টে।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। অপরিচিত নম্বর।
— “হ্যালো, আপনি কি নাদিয়া আক্তার বলছেন?”
— “জি, আমি নাদিয়া।”
— “আমি সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম, দৈনিক যুগধ্বনি থেকে বলছি। আমরা আপনার জীবনের গল্পটা নিয়ে একটি কভার স্টোরি করতে চাই। আপনি কি রাজি হবেন?”
নাদিয়ার চোখ স্থির হয়ে আসে। সে চায় না তার সন্তান আর তার নাম একসাথে খবরে উঠুক। কিন্তু আবার ভাবে—"যদি আমার গল্প আরও একজন মেয়েকে সাহস দেয়?"
— “আমি সময় নিয়ে আপনাকে জানাবো, ভাই। একটু ভাবতে দিন।”
— “অবশ্যই, আপা। আমরা অপেক্ষা করব।”
ফোনটা রেখে ছেলের কপালে একটা চুমু খায় নাদিয়া।
— “তুইই আমার শক্তি, বাবু।”
---
একদিন বিকেলে রায়হান বাড়ি ফিরে দেখে নাদিয়া অদ্ভুত চুপচাপ।
— “কি হয়েছে তোমার?”
— “তুমি কি চাও সবাই জানুক আমি কীভাবে মা হয়েছি?”
— “আমার চাইতে বড় কথা হলো, তুমি কী চাও?”
নাদিয়া জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
— “আমি চাই, আমার কষ্ট কারও উপহাস না হোক। কিন্তু যদি আমার কষ্ট আর কাউকে সাহস দেয়, তবে হ্যাঁ… আমি চাই, জানুক সবাই।”
রায়হান ওর হাত ধরে,
— “তাহলে রাজি হয়ে যাও। আমি পাশে আছি সবসময়।”
---
দৈনিক যুগধ্বনির প্রথম পাতায় নাদিয়ার মুখ—বড় করে লেখা “একজন নাদিয়ার গল্প”। নিচে সাবহেডলাইন:
**“ধর্ষণের শিকার, কিন্তু ভেঙে না পড়ে লড়েছেন, বিচার ছিনিয়ে এনেছেন। সমাজের কলঙ্ক নয়, তিনি আজ প্রেরণা।”**
সেই দিন থেকে বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু। নারীরা ফেসবুকে শেয়ার করে আর বলে,
— “আমরা সবাই নাদিয়া।”
গ্রামের কলেজের ছাত্রী রূপা এসে বলে,
— “আপা, আপনি আমার হিরো। আমি আপনাকে দেখে সাহস পাই।”
— “তুমি নিজের ভেতরে সেই সাহস খুঁজে নাও, রূপা। আমার গল্প শুধু একটা উদাহরণ।”
তবে এর মাঝে কিছু বিষাক্ত কথাও শোনা যায়—
— “এই মেয়েটার কি লজ্জা নেই?”
— “সব সময় মিডিয়ায় নিজেকে দেখায়।”
— “এ তো নাম কামানোর একটা পদ্ধতি পেয়েছে।”
রায়হান এসব শুনে রাগ হয়, কিন্তু নাদিয়া শুধু একবার হাসে।
— “তারা বোঝে না। তাদের বোঝার চোখ নেই।”
---
দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়। নাদিয়ার ছেলে এখন হাঁটতে শেখে, "মা মা" বলে ডাকে।
একদিন হঠাৎ করেই রায়হানের বাবার বড় ভাই, মানে গ্রামের প্রভাবশালী লোক—মজিবর চাচা আসেন বাড়িতে।
— “রায়হান, আমি ভাবছি, তোমাদের শহরে একটা বাসা নিয়ে দেই। এখানে তোমাদের নিয়ে অনেক কথা হয়। এই ছেলে তো তোমার নয়, সবাই জানে। কেন এসব সয়ে যাচ্ছ?”
রায়হান চুপ। মাথা নিচু করে বসে থাকে।
নাদিয়া এগিয়ে আসে। চোখে পানি নেই, কিন্তু কণ্ঠটা কঠিন।
— “চাচা, আপনি চাইলে বাসা কিনে দিতে পারেন। কিন্তু আমি কোথায় থাকব, সেটা আপনি ঠিক করবেন না। আর একটা কথা মনে রাখবেন, এই ছেলে শুধু আমার নয়, রায়হানেরও।”
চাচা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। রায়হান এবার বলে,
— “চাচা, সন্তান রক্তের না হোক, ভালোবাসার তো হয়। আমি এই ছেলেকে বাবা হিসেবেই বড় করব। সে আমার গর্ব।”
মজিবর চাচা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তিনি উঠে বলেন,
— “আজকাল মেয়েদের মুখের জোর বেড়েছে। ভালোই। তবে সময়ই সব ঠিক করবে।”
চলে যান, আর ফেরেন না।
---
একদিন রাতে রায়হান নাদিয়াকে বলে,
— “তোমার গল্প নিয়ে একটা বই বের করতে চাই। তুমি লিখবে?”
নাদিয়া বলে,
— “তুমি লিখো, আমি বলি।”
— “চলো তবে, শুরু করি। নাম কী রাখবো?”
— “হতভাগা।”
রায়হান বিস্মিত হয়,
— “এই নাম?”
— “হ্যাঁ। কারণ প্রথম দিন থেকেই সবাই আমায় এই নামে ডেকেছে। এবার আমি এই নামকেই গর্বে পরিণত করবো।”
---
বই প্রকাশিত হয় ৬ মাস পরে। সাহিত্য মেলায় সেই বইয়ের স্টলে ভিড়—"হতভাগা: এক সাহসিনীর কাহিনি"। অনেকেই অটোগ্রাফ নেয়। কিছু লোক কাঁদে, কিছু হাসে, কিছু মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ বলে,
— “আপনি শুধু লেখক না, আপনি যোদ্ধা।”
এমন সময় স্টলে আসে এক যুবক, তার চোখে কান্না, কণ্ঠ কাঁপা।
— “আপনি যদি আমার বোন হতেন, তাহলে আমি গর্ব করতাম। আমি আপনার মতো একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।”
নাদিয়া বলে,
— “তুমি পাশে থাকো, যাতে আর কোনো মেয়ে একা না পড়ে।”
---
এক সন্ধ্যায়, রায়হান ঘরে এসে দেখে নাদিয়া ছেলের হাতে একটা ছোট খেলনার গাড়ি দিয়ে বলছে,
— “জানো, বাবা একসময় তোমার জন্য একটা আসল গাড়ি কিনবে।”
ছেলেটা হাসে। ছোট্ট দাঁতগুলো ঝিলমিল করে।
রায়হান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবে,
— “এই দুই প্রাণই এখন তার পৃথিবী। এই দুইজনই তাকে মানুষ করে দিচ্ছে। দায়িত্বশীল করে তুলেছে।”
সে ধীরে ধীরে এসে বলে,
— “আমি তোমাদের নিয়ে আরও কিছু করতে চাই। চাই, ‘হতভাগা’ নামে একটা সংগঠন গড়ি—যেখানে নির্যাতিত মেয়েরা কথা বলবে, লড়বে, নিজেদের মতো করে বাঁচবে।”
নাদিয়া বলে,
— “তোমার ভাবনাটা আমার নিজের মতো মনে হচ্ছে।”
তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কাজ শুরু হবে আগামী মাস থেকে। গ্রামের পাশেই একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া নেয়, যেখানে একটি সেল্টার হোম আর কাউন্সেলিং সেন্টার গড়ে তোলা হবে।
---
**শেষাংশে…**
সন্ধ্যা নামছে। আকাশ লালচে রঙ ছুঁয়ে নিচে নেমে আসছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। ঠিক তখনই, নাদিয়া বারান্দায় বসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে,
— “শোনো, বাবু, আমি একদিন হতভাগা ছিলাম। সবাই সেই নামে ডাকত। কিন্তু আজ আমি একজন মা, একজন যোদ্ধা, একজন পথপ্রদর্শক। তুমি একদিন জানবে, তুই আমার সমস্ত হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে এনেছিস। আমি গর্ব করি তোর জন্য। আমি গর্ব করি আমার জীবনের জন্য।”
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে বলে,
— “মা… মা…”
নাদিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি, এক গভীর আত্মবিশ্বাস। সে জানে, জীবন তাকে ভেঙে ফেলতে পারেনি। সে জানে, এখন কেউ তাকে **“হতভাগা”** বললে সে গর্ব করে মাথা তুলে বলবে—
**“হ্যাঁ, আমি সেই হতভাগা, যে হার মানেনি।”**
---
**চলবে…
পর্ব: ৪
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
💝হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।
⭕শত্য প্রযোজ্য।
0 Post a Comment:
Post a Comment