হতভাগা
পর্ব ৫: অজানা পথের যাত্রী
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নদিয়ার। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। পাশেই ছোট্ট বালিশে ঘুমিয়ে আছে ওর ছেলেটা, নাম রেখেছে নিলয়। সাত মাস বয়স, চোখে-মুখে বাবার ছায়া, অথচ সেই বাবাই কোথায় আজ, নদিয়া জানে না। নিলয়ের মুখের দিকে তাকালে নদিয়ার মনে হয়, এই ছোট্ট মুখটাই যেন তার অস্তিত্ব। সে যেন আর নিজেকে নিয়ে ভাবে না, ভাবে শুধু নিলয়কে নিয়ে।
নদিয়া এখন একটি মেসে থাকে—রামপুরার গলির মধ্যে, পাঁচজন মেয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটা ছোট ঘর। ঘর বলতে চারদিকে ইটের দেয়াল, একটা জানালা, আর একটা বাথরুম। ঘর ভাড়া দেয় এক অবিবাহিত মহিলা, নাম পারভীন, বয়স পঁচিশ ছুঁই ছুঁই। ও-ও একসময়ে পরিবার ছেড়ে এসেছিল, স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার, কিন্তু সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশে গেছে।
নদিয়া চাকরি নেয়েছে একটা বুটিক হাউজে—বাগিচা ফ্যাশন নামে এক দোকান। মিরপুর রোডে অবস্থিত, ওখানে সে কাপড় ভাঁজ করে, কখনও কাস্টমার সামলায়, আবার কখনও ঝাড়ু দেয়। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ, বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায়ই চলে ওর ও নিলয়ের খরচ। মাঝে মাঝে পারভীন বা পাশের মেয়েরা সাহায্য করে। তবে নদিয়া কারও কাছে হাত পাততে চায় না, চেয়েও না।
সন্ধ্যা নামলে নদিয়া এক কোণে বসে কাপড় সেলাই করে। ওর মা ছোটবেলায় তাকে সুই-সুতো ধরতে শিখিয়েছিল। সেই হাতের কাজই এখন ওর সবচেয়ে বড় ভরসা। কয়েকটা নিয়মিত কাস্টমার পেয়েছে সে—কারও ব্লাউজ ফিটিং, কারও সালোয়ারের পাড় লাগানো, তো কারও আবার নতুন কুর্তি বানানো। এই বাড়তি ইনকামে মাসের শেষে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
একদিন দোকানে হঠাৎ এক নতুন ক্রেতা আসে—মাঝবয়সী, সুপরিচিত চেহারা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনার নাম নদিয়া না?” নদিয়ার বুক ধক করে ওঠে। “আপনি কে?” সে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
লোকটা হেসে বলে, “আমি রায়হান। একটা এনজিও-তে কাজ করি, শহরের আশ্রয়হীন মা ও শিশুদের নিয়ে।”
নদিয়া কেমন যেন বিব্রত হয়। “আপনি কীভাবে চিনলেন আমাকে?”
“আমার সহকর্মী একদিন এই দোকান থেকে কিছু কিনেছিল, তোমার কথাও বলেছিল। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম—তুমি কেমন আছো।"
রায়হান বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলে, তারপর একদিন মেস পর্যন্ত আসে। পারভীনের সঙ্গে কথা বলে, তারপর নিলয়ের সঙ্গেও খেলে। নদিয়া বিস্মিত হয় এই মানুষটার আন্তরিকতায়।
তারপর একদিন রায়হান প্রস্তাব দেয়, “তুমি চাইলে আমাদের এনজিও-তে শিশুদের জন্য একটি ডে-কেয়ার সুবিধা পাবে। তুমি সকালবেলা নিলয়কে দিয়ে এসে কাজ করতে পারো। ওখানে ওর খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো সব ব্যবস্থাই থাকবে।”
নদিয়ার চোখে জল আসে। এতদিন নিলয়কে ঘরে রেখে কাজে যাওয়া, মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে মেসের মেয়েরা দেখত, কিন্তু মন তো পড়ে থাকত ছেলেটার দিকেই। এখন যদি একটু নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে!
নদিয়া রাজি হয়। পরদিনই রায়হান তাকে নিয়ে যায় সেগুনবাগিচায় ‘আলোকধারা’ নামের সেই এনজিও-তে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, দায়িত্বশীল কর্মী, খেলার সামগ্রী—সব দেখে নদিয়ার মন ভরে যায়।
সেই থেকেই নদিয়ার জীবনে ধীরে ধীরে বদল আসে। সে নিয়মিত কাজ করে, সন্ধ্যায় ফিরে নিলয়কে নিয়ে গল্প করে, ছুটি পেলে মাঠে নিয়ে যায়। নিলয়ও ওর হাসি দিয়ে পৃথিবীটা বদলে দিতে পারে যেন।
কিন্তু সমাজ কি থেমে থাকে?
একদিন মিরপুর রোডের দোকানে এক পুরোনো পরিচিত এসে দাঁড়ায়—নদিয়ার খালাতো ভাই। “তুই এখানে?” তার গলায় বিষ। “মায়ের মুখ ডুবিয়েছিস, বাচ্চা নিয়ে দোকানে কাজ করিস? নাম না করলি ভালো, শোন!”
নদিয়া একটুও থামে না। সে মাথা উঁচু করে বলে, “আমার কাজের গরিমা আছে। আমি চুরি করি না, ভিক্ষা করি না। বাচ্চা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি।”
লোকটা আর কিছু না বলে চলে যায়। কিন্তু তার কথা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে নদিয়ার মনে।
রায়হান একদিন নদিয়ার হাতে একটি কাগজ দেয়। “আমরা কিছু মায়েদের নিয়ে একটা আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করছি। তুমি চাইলে তোমার জীবনের গল্পটা লিখে দাও। অনেকে তোমার মতো সাহস খুঁজে পাবে।”
নদিয়া ভয় পায়। নিজের দুঃখের কাহিনি কে জানবে? কে পড়ে দেখবে? কিন্তু আবার ভাবে—যদি একজন নারীও পড়ে অনুপ্রাণিত হয়, তাহলেই বা ক্ষতি কী?
সে লিখতে শুরু করে। প্রতিরাতে কিছু করে লিখে, এক মাস পরে দেয় রায়হানের হাতে। রায়হান পড়ে শেষ করে বলে, “তুমি জানো না, তোমার ভেতরে কী শক্তি আছে নদিয়া।”
বইটি প্রকাশিত হয়—“হতভাগা থেকে যোদ্ধা” নামে।
সাংবাদিকেরা খোঁজ নেয়, সাক্ষাৎকার নেয়। নদিয়ার নাম উঠে আসে কাগজে, ম্যাগাজিনে।
একদিন এক টিভি চ্যানেল থেকে ফোন আসে—“আপনাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।”
নদিয়া চমকে যায়। সে কি পারবে? সে কি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারবে?
রায়হান তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি তো প্রতিদিন সাহস দেখাও, এইটুকু তো তুচ্ছ।”
নদিয়া যায়। অনুষ্ঠান হয়। দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়। সেই হাততালির শব্দে হারিয়ে যায় আগের সব অপমান, লজ্জা, দুঃখ।
তবে, সুখ কখনও চিরস্থায়ী হয় না।
এক সন্ধ্যায়, যখন নদিয়া নিলয়কে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল, একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জানালার কাঁচ নেমে যায়।
সেখানে এক পরিচিত মুখ—নিলয়ের বাবা!
চোখে চশমা, মুখে একটু বয়সের ছাপ, কিন্তু নদিয়ার মনে পড়ে সেই রাতের কথা, সেই প্রতিশ্রুতি, সেই ফেলে যাওয়া ভোর।
লোকটি শুধু একটুকু বলে, “নদিয়া, আমাকে একটু সময় দাও... আমি সব কিছু বোঝাতে চাই।”
নদিয়া নিশ্চুপ। কোলে ঘুমন্ত নিলয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। পুরোনো ক্ষত যেন হঠাৎ আবার ফেটে গেল।
(চলবে...)
💝হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।
⭕শত্য প্রযোজ্য।
💝প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুরোধ!
আপনি যখন আমার গল্পটি পড়ছেন, তখন শুধু একটি গল্পই নয়—আমার স্বপ্নকেও সমর্থন করছেন। গল্পের শেষে থাকা **মাত্র ৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি** ক্লিক করলে আমার সামান্য আয় হয়। ফেসবুক বা ওয়েবসাইট সরাসরি আয় দেয় না, কিন্তু **আপনার একটি ক্লিক** আমাকে নিয়মিত গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করে!
এই ছোট্ট সহযোগিতাটুকুই আমার জন্য বিশাল। আপনার ভালোবাসা আর সমর্থন পেলে আমি আরও মন দিয়ে গল্প লিখতে পারব। ❤️
**🔗 বিজ্ঞাপন লিঙ্ক:** 👇
**#আপনার_এক_ক্লিক_আমার_অনুপ্রেরণা**
✨ **ধন্যবাদ** আমার গল্পের পাশে থাকার জন্য!
৪থ পর্ব লিংক👇
https//mgugoloplikestorehotobagapartth
0 Post a Comment:
Post a Comment