গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৬
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
রাত দশটা। 'হতভাগা' আশ্রয়কেন্দ্রের অফিসঘরে বসে নাদিয়া আগের দিনের কাগজপত্র মিলিয়ে দেখছে। হঠাৎ করেই বাইরে এক নারীর কান্নার শব্দ ভেসে এলো। নাদিয়া দেরি না করে ছুটে গেল মূল ফটকের দিকে।
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে—বয়স সতেরো কি আঠারো। গায়ে রক্ত, চোখ ভয়ে ভরা। কোলে একটা ছোট্ট পুঁটলি। নাদিয়া তার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলো।
— "তুমি নাম বলো মা, ভয় পেও না। আমরা তোমার পাশে আছি।"
মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে—
— "আমি পায়েল... বিয়ের নাম করে এক লোক আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। পরে বিক্রি করে দেয় এক দালালের হাতে। আমি পালিয়ে এসেছি। পেটের এই বাচ্চাটা সেই পাপের ফল।"
নাদিয়া নিঃশ্বাস টেনে বলে—
— "এই ঘরটা কোনো পাপ দেখে না, শুধু দেখে সাহস। তুমি এখন থেকে নিরাপদ।"
কিন্তু পায়েলের আগমনের পর থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রকে নিয়ে বাইরের সমাজে আবার প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া পোস্ট, নিউজপোর্টালে শিরোনাম—
“হতভাগা: নারী আশ্রয়ের আড়ালে কি অন্য ব্যবসা?”
এমতাবস্থায় একদিন প্রশাসনের একটি দল আসে তদন্তে। থানার এক পুলিশ অফিসার, সমাজসেবা অধিদপ্তরের দুজন কর্মী এবং সাংবাদিকের দলসহ এক বিশাল তদারকি।
তদন্ত শুরু হয় পায়েলকে ঘিরে। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে,
— “তুমি কি নিশ্চিত এই আশ্রয়কেন্দ্র নিরাপদ?”
পায়েল মাথা নিচু করে বলে,
— “আপনারা যদি ওনাদের এখানে না আনতেন, আমি হয়তো আজ কাঁদতেই পারতাম না। আমার কান্নারও জায়গা নেই ছিলো। এখানে আমি আছি, শুধু তা-ই না—বাঁচছি।”
রায়হান সোজা দাঁড়িয়ে বলে—
— “আপনারা প্রশ্ন করেন আমাদের বিরুদ্ধে? দোষ আমাদের না, সমাজের, যে পায়েলের মতো মেয়েদের ভয় দেখায়, আর সাহসীদের সন্দেহ করে।”
এক সাংবাদিক তীব্র প্রশ্ন ছোড়ে,
— “আপনার স্ত্রী নাদিয়া নিজেও তো একটি বিতর্কিত চরিত্র। একজন ‘অবৈধ’ সন্তানসম্ভবা নারী হিসেবে সমাজ আপনাকে ক্ষমা করেনি। আপনি কীভাবে তাকে সংগঠনের মুখ বানালেন?”
নাদিয়া তখন ধীর কণ্ঠে বলে—
— “যে সমাজ অবৈধ শব্দ দিয়ে একজন নারীর চরিত্র বিচার করে, তারা কি কখনো পুরুষের চরিত্র প্রশ্ন করে? আমার সন্তান অবৈধ না—অবহেলিত সমাজে জন্ম নিয়েছে, তবু সে সম্মানের দাবিদার।”
এমন সাহসী জবাবে পুরো ঘরে স্তব্ধতা। একজন মহিলা সমাজকর্মী ধীরে ধীরে হাততালি দেয়। তারপর সবার মুখে সেই তালি ছড়িয়ে পড়ে।
এরই মাঝে রুবিনা—সেই পুরোনো প্রতিবেশী, যে একসময় নাদিয়াকে নোংরা অপবাদ দিয়েছিলো, হঠাৎ এসে ক্ষমা চায়।
— “ভাবি, আমি একটা ভুল করেছিলাম। আমার বলা কথায় তোমার জীবনে অনেক বিপদ হয়েছিলো। এখন বুঝি, তুমি যা করেছো, অনেক মেয়ে তা করতে পারে না।”
নাদিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।
কিন্তু পরে দেখা যায়, রুবিনা এখন একটি নতুন NGO-র হয়ে কাজ করছে, যারা 'হতভাগা' কেন্দ্র বন্ধ করার জন্য তৎপর। তার ক্ষমা ছিল এক নাটক, একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অংশ।
একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় নাদিয়া দেখতে পায়—আশ্রয়কেন্দ্রের দেয়ালে স্প্রে করে লেখা:
“নাদিয়া = চরিত্রহীন। হতভাগা = পাপের কারখানা।”
রায়হান ফুঁসে ওঠে।
— “এদের থামাতে হবে। আইনিভাবে, সামাজিকভাবে।”
নাদিয়া মাথা ঠান্ডা রেখে বলে—
— “তারা আমাদের টানতে চায় আবর্জনার মধ্যে। আমরা বরং আলো জ্বালাই, যাতে ওদের অন্ধকার আরও স্পষ্ট হয়।”
রায়হান সিদ্ধান্ত নেয়—রুবিনার বিরুদ্ধে কোর্টে মানহানির মামলা করবে। প্রমাণ আছে—ভিডিও, কলরেকর্ড, ফেসবুক পোস্ট।
কিন্তু ঠিক সেই সময় নাদিয়া রায়হানকে থামে—
— “তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও, নাকি ন্যায় বিচার চাও?”
রায়হান জবাব দেয়—
— “আমি চাই, যারা আমাদের বন্ধ করতে চায়, তারা বুঝুক—সত্যি কখনো থামে না।”
নাদিয়া তখন বলে—
— “তাহলে প্রতিশোধ নয়, পথ দেখাও। আমরা মিডিয়াতে একটা ওপেন প্রেস কনফারেন্স করি। সমস্ত মেয়ে যারা এখান থেকে নতুন জীবন পেয়েছে, তাদের সামনে আনো। সত্যিটা ওরাই বলবে।”
এবং হয় ঠিক তাই। দিন নির্ধারিত হয়—“হতভাগা সত্য সম্মেলন”।
একটি অডিটোরিয়ামে বড় করে ব্যানার টানানো হয়েছে—
“আমরা কলঙ্ক নই—আমরা বেঁচে থাকার গল্প”
প্রথম বক্তা সীমা—
— “আমার স্বামী আমার চোখের সামনে আমার মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেদিন আমি মরতাম। কিন্তু নাদিয়া আপা আমাকে বলেছিলো, ‘তুমি মরলে ওরা জিতবে’। আজ আমি একটি নার্সিং ট্রেনিং কোর্স শেষ করেছি।”
পরের বক্তা পায়েল—
— “আমি শুধু নিজের সন্তানের জন্যই না, সেই মেয়েদের জন্যও বাঁচতে চাই যারা আজও কাঁদে। ভাবি আমাকে নাম দিয়েছেন ‘আলো পায়েল’। আমি এখন আঁধারকে ভয় পাই না।”
মঞ্চে ওঠে নাদিয়া। তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, শুধু দৃঢ়তা—
— “আজ যারা আমাদের প্রশ্ন করছে, তাদের জবাব দিয়েছে এই মেয়েগুলো। যারা একদিন সত্যিই ‘হতভাগা’ ছিল, আজ তারা সমাজের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ—কারণ তারা বেঁচে আছে, মাথা উঁচু করে।”
তদন্তের পর আদালতের নির্দেশে রুবিনার NGO-র কার্যক্রম স্থগিত হয় এবং তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা চলে। সব প্রমাণ দেখে রায়হান শেষমেশ মামলা তুলে নেয়।
নাদিয়া বলে—
— “আমরা দেখালাম, ক্ষমা করা মানেই দুর্বলতা নয়। সেটাই আমাদের শক্তি।”
ঠিক তখনি ফোন আসে—শাহিনুর বেগম মারা গেছেন।
নিরবতা ছায়ার মতো ঘর জুড়ে বসে পড়ে। রায়হান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ে।
— “আমি তো ভাবতাম, একদিন ওনার কোলেই মাথা রাখব… আর সে দিনটা আসার আগেই সব শেষ।”
নাদিয়া তার হাত ধরে বলে—
— “তুমি তার সন্তান। যত ক্ষোভই থাক, মা কখনো শেষ হয় না। আর তুমি তো তার জন্যই লড়ছিলে… সেটা জানলে তিনি শান্তি পাবেন।”
মায়ের কবর থেকে ফিরে রায়হান আর নাদিয়া সিদ্ধান্ত নেয়—'হতভাগা' এখন শুধু আশ্রয়কেন্দ্র নয়, এটি হবে একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
নতুন প্রজেক্টের নাম হয়—“হতভাগা স্কিল একাডেমি”
যেখানে নারী ও শিশুদের জন্য থাকবে কম্পিউটার ট্রেনিং, হস্তশিল্প, সেলাই, নার্সিংসহ আরও নানা কোর্স।
উদ্বোধনের দিন রায়হান বলে—
— “আমরা হয়তো সমাজকে বদলাতে পারি না পুরোপুরি। কিন্তু অন্তত কিছু জীবন বদলে দিতে পারি। আর সেটাই আমাদের সার্থকতা।”
চলবে…
পর্ব: ৬
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
📗প্রিয় পাঠক পাঠিকরা হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf📄 নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।
💝প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুরোধ!
আপনি যখন আমার গল্পটি পড়ছেন, তখন শুধু একটি গল্পই নয়—আমার স্বপ্নকেও সমর্থন করছেন। গল্পের শেষে থাকা **মাত্র ৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি** ক্লিক করলে আমার সামান্য আয় হয়। ফেসবুক বা ওয়েবসাইট সরাসরি আয় দেয় না, কিন্তু **আপনার একটি ক্লিক** আমাকে নিয়মিত গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করে!
এই ছোট্ট সহযোগিতাটুকুই আমার জন্য বিশাল। আপনার ভালোবাসা আর সমর্থন পেলে আমি আরও মন দিয়ে গল্প লিখতে পারব। ❤️
**🔗 বিজ্ঞাপন লিঙ্ক:** 👇
**#আপনার_এক_ক্লিক_আমার_অনুপ্রেরণা**
✨ **ধন্যবাদ** আমার গল্পের পাশে থাকার জন্য!
৪থ পর্ব লিংক👇
https//mgugoloplikestorehotobagapartth
0 Post a Comment:
Post a Comment