পর্ব: ৭ গল্প: হতভাগা লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৭
নতুন পথ, পুরোনো ছায়া
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



সকালবেলা ‘হতভাগা স্কিল একাডেমি’র মূল ফটকে এক অচেনা গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নামল সুসজ্জিত এক যুবক—গা শিরশিরে ঠান্ডা চোখ, পরিপাটি পোশাক, হাতে দামি ঘড়ি, কাঁধে ব্যাগ।

তিনি সোজা রিসিপশনে এসে বলেন—
— “আমি আরমান হোসেন। UNHCR-এর পক্ষ থেকে এসেছি। আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও সহায়তা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।”

রায়হান এবং নাদিয়া বিস্মিত। এতদিনে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ দেখাল?
আরমানকে বসানো হয় সভাকক্ষে। কাগজপত্র, প্রজেক্ট রিপোর্ট, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব উপস্থাপন করা হয়।

আরমান মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখে বলেন—
— “আমি সত্যিই অভিভূত। বাংলাদেশে এমন মানবিক কাজ খুব কম দেখা যায়। UNHCR একাধিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে—বিশেষত নারী পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়ন নিয়ে। ‘হতভাগা’ আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।”

নাদিয়া মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানায়।

তবে রায়হানের মনে একটা কাঁটা যেন খচখচ করে। যুবকের চোখে যেন কিছু লুকানো কুয়াশা।



চায়ের ফাঁকে আরমান বলেন—
— “আপনারা জানেন, একজন অসহায় নারী যখন নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তখন সে শুধু নিজেকে না, একটা প্রজন্মকে বাঁচায়। UNHCR চায়, আপনাদের এই উদ্যোগকে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে তৈরি করতে।”

নাদিয়ার চোখ জ্বলে ওঠে—
— “এমন স্বীকৃতি যদি পাই, তবে সমাজের চোখ খুলবে। আমাদের আর বলতে হবে না—আমরা ‘হতভাগা’ নই, আমরা ভাগ্য নির্মাতা।”

আলোচনা শেষে আরমান নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন—
— “আপনার গল্প আমি জানি। আপনি আমার জন্য এক অনুপ্রেরণা। কিন্তু আমি এসেছি শুধু দায়িত্ববোধ থেকে না, আরও কিছু আছে…”

নাদিয়া চমকে ওঠে।

আরমান নিচু স্বরে বলে—
— “আমি আপনাকে আগে থেকেই চিনতাম। আমি ছিলাম আপনার প্রাক্তন কলেজমেট—তখন আমি ছিলাম অনামিকা নামে পরিচিত। হ্যাঁ, আমি ট্রান্সজেন্ডার।”

ঘরে নিস্তব্ধতা।

রায়হান চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে।

নাদিয়া ধীরে ধীরে বলে—
— “তুমি… তুমি সেই অনামিকা? যে নাকি চুপচাপ থাকতো, কারো সাথে মিশতো না, আর সবাই তাকে কটাক্ষ করতো?”

আরমান মাথা নাড়ে—
— “হ্যাঁ। তুমি একমাত্র যে আমাকে ‘লুকিয়ে থাকা ফুল’ বলেছিলে। সেই সাহসী কথাটাই আমাকে গড়েছে।”



সন্ধ্যা। অফিসঘর ফাঁকা। নাদিয়া একা বসে। দরজা খুলে আরমান আসেন।
নাদিয়া বলেন—
— “তোমার পরিবর্তন দেখে অভিভূত হয়েছি। তুমি তো এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে... মনে আছে সেই ছাদে দাঁড়ানো সন্ধ্যাটা?”

আরমান হেসে ফেলে—
— “তোমার ফোনটাই আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো। তুমি বলেছিলে, ‘যদি সবাই তোমাকে না বোঝে, তার মানে তুমি আলাদা নও, ওরা অন্ধ।’ সেই কথাটা আমার পৃথিবী বদলে দেয়।”

নাদিয়ার চোখে জল। এতগুলো বছর পর পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে যেন একটুকরো চাঁদ খুঁজে পেল সে।

আরমান বলেন—
— “এখন আমি চাই, তোমার মতো সাহসী নারীদের পাশে দাঁড়াই। তোমার প্রতিষ্ঠানে ট্রান্স নারী বা পুরুষদের জন্য আলাদা ট্রেনিং সেল খোলার পরিকল্পনা আছে আমার।”

নাদিয়া বলে—
— “তোমাকে আমি একদিন একবারই বলেছিলাম, ‘তুমি সুন্দর’। আজ আমি সত্যিই গর্বিত—তুমি নিজেই এখন এক অনন্য সৌন্দর্য।”



আরমানের প্রস্তাবে ‘হতভাগা’ একাডেমিতে শুরু হয় ‘রূপান্তরিত মানুষদের জন্য বিশেষ কোর্স’। নাম হয়—"রংধনু শাখা"

তিনজন ট্রান্স নারী এসে ভর্তি হন—
১. শেফালী: যিনি নাচ জানেন, কিন্তু নাচের মাধ্যমে সম্মান পাননি কখনো।
২. মিন্টু: ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কিন্তু লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে চাকরি পায়নি।
৩. রোকসানা: যাকে পরিবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

তাদের নিয়ে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। সমাজের চোখে প্রশ্ন, কটূক্তি, ট্রল—সবকিছুকে জয় করার যুদ্ধ।

কিন্তু নতুন ঝড় আসে সেই রাত্রিতে।



রাত্রি দুইটা। অফিসের পেছনের দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
সিসি টিভিতে দেখা যায়, মুখোশধারী চারজন ভেতরে ঢুকে কাগজপত্র তছনছ করেছে। ট্রান্স অংশগ্রহণকারীদের ডেটা এবং রেজিস্টার চুরি গেছে।

পুলিশ আসে। রায়হান বলেন—
— “এটা সাধারণ চুরি না। তারা আমাদের থামাতে চায়—আমাদের ‘বিপ্লব’কে থামাতে চায়।”

নাদিয়া চিন্তায় পড়ে যায়।
আরমান বলেন—
— “আমি বুঝতে পারছি কে এর পেছনে। দক্ষিণাঞ্চলে একদল ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী আছে, যারা নারী ও রূপান্তরিত মানুষদের ক্ষমতায়নকে বিরোধিতা করে।”

রায়হান চিন্তিত—
— “তবে কি আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে?”

আরমান বলেন—
— “আমরা UN-এর সহায়তায় ডিজিটাল সিকিউরিটি ও নিরাপদ নথি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আনব।”



এর মাঝে পায়েল তার সন্তানের জন্ম দেয়। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো কাঁদে না কেউ—সবাই খুশিতে হাসে।
পায়েল তার সন্তানের নাম রাখে—আলো

নাদিয়া তাকে বলে—
— “এই আলো হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। সে জানবে, পাপ তাকে তৈরি করেনি—ভালোবাসাই করেছে।”

সেই সময় শেফালী একটি থিয়েটার গোষ্ঠী তৈরি করে, যেখানে সমাজে বঞ্চিত ট্রান্স ও নারী সদস্যরা মঞ্চনাটক করে। প্রথম নাটকের নাম—“হতভাগা কাহিনী”



আরমানের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা দেখে আবার মুখ তোলে রুবিনা।
সে এবার একটি মিডিয়ায় কাজ করছে এবং একটি “এক্সপোজে” তৈরি করে—যেখানে দেখানো হয়, ‘হতভাগা’ কেন্দ্র নাকি LGBTQ+ প্রচারকেন্দ্র।
ভিডিও ভাইরাল হয়। দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়।

বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এর প্রতিবাদ করে।

রায়হান বলেন—
— “তারা আবার সেই পুরোনো অস্ত্র ব্যবহার করছে—ঘৃণা, অপবাদ, ভয়ের রাজনীতি।”

নাদিয়া বলেন—
— “আমরা কি থামবো?”

আরমান বলেন—
— “না। এই যুদ্ধটা আমাদের পরিচয়ের, মর্যাদার, এবং ভবিষ্যতের। এ যুদ্ধ ভালোবাসার।”



‘হতভাগা’ এবার পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে। সেখানে রায়হান স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
— “আমরা কারো ধর্মের বিরুদ্ধে না, আমরা শুধু মানুষের পাশে।
আমরা নারী, পুরুষ, ট্রান্স—সবাই মানুষ হিসেবে থাকতে চাই।
আমাদের অপরাধ শুধু একটাই—আমরা বাঁচতে চাই।”

আরমান বলেন—
— “যারা ভয় দেখায়, তারা জানে না—ভালোবাসা ভয়কে জিতিয়ে দেয়।”

মিন্টু দাঁড়িয়ে বলে—
— “আমি আর কাঁদবো না। আমি মিন্টু—একজন মানুষ। যন্ত্র ঠিক করতেও পারি, হৃদয়ও।”

থিয়েটার দল তাদের প্রথম নাটক নিয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে ডাক পায়। এবং ‘হতভাগা’ আন্তর্জাতিক NGO সম্মেলনে পুরস্কার পায় “Inclusive Model of Empowerment” হিসেবে।


চলবে…


পর্ব: ৭
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



0 Post a Comment:

Post a Comment