গল্প: হতভাগা পর্ব: ৮ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৮
শিকড়ের দিকে ফিরে দেখা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



“মা, আমি তো বলেছিলাম না, আমাকে তোমার মতো হতে হবে না। আমি আমার মতো হয়ে উঠবো।”
— এই কথা বলে ১০ বছর বয়সী আরিজ দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

নাদিয়া চুপচাপ বসে থাকে। সামনে জন্মদিনের কেক, পাশে রায়হান, আর চারপাশে ‘হতভাগা’র মেয়ে ও ছেলে সদস্যরা—কিন্তু যেন উৎসবের মাঝে ছায়া নেমে আসে।

আজ আরিজের জন্মদিন। দশ বছর পার হয়েছে। একটি শিশুর বেড়ে ওঠা, তার হাজারো প্রশ্ন, সমাজের কটুকথা, বাবার অনুপস্থিতি—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে সে আজ স্কুলের সেরা ছাত্রদের একজন।

কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আরিজের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন।

সে একা থাকে, বই পড়ে, কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যায়।

রায়হান বলে—
— “ওর ভিতরে কিছু চাপা পড়ে আছে। সময় এসেছে, ওর সাথে সত্যি কথা বলার।”

নাদিয়া আরিজের রুমে ঢোকে। দেয়ালে আঁকা ছবি—একটা পাহাড়, যার নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু, আর সামনে একটি অন্ধকার গুহা।

নাদিয়া জিজ্ঞেস করে—
— “তুমি কি ভয় পাচ্ছো আরিজ?”

আরিজ চুপ থাকে।

— “তোমার কী জানতে ইচ্ছে করে, তোমার বাবা কে? কেন কেউ আসেনা তোমার জন্মদিনে?”

আরিজ ধীরে ধীরে ঘাড় তোলে—
— “মা, আমার স্কুলে আজ কেউ বলেছে, ‘তোর তো বাবা নেই, তোর মা তো… তুমি জানো না, তুমি কার সন্তান।’ আমি জানতে চাই। তুমি আমাকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছো।”

নাদিয়ার মুখ শুকিয়ে যায়।

সে বলে—
— “তুমি আমার প্রাণ, আমার অন্ধকার সময়ের আলো। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার জন্ম সহজ ছিল না। তোমার জন্ম আমার লাঞ্ছনার সাক্ষী, কিন্তু ভালোবাসারও।”

আরিজ বলে—
— “আমি জানি না আমি কার সন্তান, মা। কিন্তু আমি জানতে চাই—সে কোথায়? সে কে?”



নাদিয়া কাঁপা হাতে একটা ধূলিধূসর বাক্স বের করে। সেখানে রাখা পুরোনো ডায়েরি, হাসপাতালের রিপোর্ট, মামলার কাগজপত্র—আর একটি অজানা চিঠি।

চিঠিতে লেখা:
“নাদিয়া,
তুমি যেটা করছো, সেটা সমাজের চোখে অপরাধ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তুমি এক যোদ্ধা। আমি যদি কখনও আরিজকে দেখে যেতে না পারি, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমি জানি, তুমি তাকে মানুষ করবে, ঠিক আমার মতো নয়—তোমার মতো।”


(এক সময়ের বাড়ির ড্রাইভার, যার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল নাদিয়া… যার বিরুদ্ধে কেউ কখনও মামলা করেনি, কারণ সে অদৃশ্য হয়েছিল)।

রায়হান তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে—
— “তুমি আমাকে কখনো বলেনি, সে এক ধর্ষণ ছিল, নাকি সম্মতি ছিল?”

নাদিয়া বলে—
— “আমি নিজেও বুঝিনি। একাকীত্ব, শূন্যতা, অবহেলা—এসবের ভেতর দিয়ে একজন মানুষ কখন কতটা ভেঙে পড়ে, তা বোঝা যায় না। কিন্তু হ্যাঁ, আমি কোনোদিন বাধ্য হইনি, আবার সজ্ঞানেও ছিলাম না। তাই আমি তাকে কখনো দোষ দিইনি।”



পরদিন আরিজ এসে জানায়—
— “আমি বাবাকে খুঁজে বের করবো, মা। যদি সে বেঁচে থাকে, আমি তার মুখোমুখি হতে চাই।”

নাদিয়া বাধা দেয় না।

রায়হান সহায়তা করে। তারা খোঁজ নিতে শুরু করে—নাম, ঠিকানা, পুরনো বন্ধুদের স্মৃতি, গুমের তালিকা।

অবশেষে এক সন্ধ্যায় একটি NGO থেকে খবর আসে—“আমরা একজন মানুষের সন্ধান পেয়েছি, যিনি ১০ বছর আগে একটি আশ্রমে ছিলেন মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায়। তার নাম পাওয়া যায়নি, কিন্তু তিনি বারবার বলে যান, ‘আমার ছেলেকে আমি খুঁজে পাবো...’”



নদীর পাশে একটি পরিত্যক্ত শ্মশান ঘরে ছোট্ট কুঁড়ে তৈরি। সেখানে বসে আছে একজন বৃদ্ধ, মুখে দাড়ি, গায়ে ময়লা চাদর।

আরিজ তাকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

সে সামনে গিয়ে বলে—
— “তুমি কি আমাকে চেনো?”

বৃদ্ধ তাকিয়ে দেখে, তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে।

— “তুই... তুই আলো! আমি তোর জন্যই বেঁচে ছিলাম। তুই আমার ভুলের ফল না, তুই আমার বাঁচার কারণ।”

নাদিয়া এসে দাঁড়ায়, কাঁদে।

সানজিদ বলে—
— “আমি কোনোদিন ক্ষমা পাবো না। আমি তো তোর মা'কে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু নিজের সীমা ভুলেছিলাম। তারপর সমাজ, ঘৃণা, ভয় আমাকে পাগল করে দিয়েছিল।”

আরিজ বলে—
— “তুমি যদি ভুল করে থাকো, তবে আমার জন্ম কি শুধুই দুঃখ?”

নাদিয়া বলে—
— “না, তুমি আমার জীবন। সে যাই হোক, তুমি মানুষ, আর তুমি জানার অধিকার রাখো কে তোমার শিকড়।”



ফিরে আসার পথে একদল সাংবাদিক রেকর্ড করে সবকিছু।
খবরের শিরোনাম হয়:
"হতভাগার প্রতিষ্ঠাতা একজন ধর্ষকের সন্তানের মা?"
"শিশুকে সত্য বলার শিক্ষা, নাকি অপরাধীর সাথে পুনর্মিলন?"

সরকারি অনুদান স্থগিত। সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। নাদিয়াকে হয়রানি শুরু হয়।

UNHCR আর্থিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দেয়।

রায়হান বলে—
— “তুমি কি চাইছো আমি তোমাদের থেকে সরে যাই?”

নাদিয়া বলে—
— “না। আমি আরিজকে সত্য শিখিয়েছি, কিন্তু সমাজের মুখে তালা দিতে পারিনি। এখন যদি আমরা চুপ থাকি, তবে ওর সাহসও মরে যাবে।”


নাদিয়া সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।

তিনি বলেন—
— “আমি একটি শিশু জন্ম দিয়েছিলাম, ঘৃণার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসা দিয়েছি। আমি চাইনি আমার সন্তান প্রতিশোধে বড় হোক, চাইনি সে ঘৃণা করতে শিখুক। আজ যদি সমাজ আমার মুখ দেখে বলে আমি অপরাধী, তবে বলি—হ্যাঁ, আমি অপরাধ করেছি—একটি সন্তানকে বাঁচিয়ে তোলা, তাকে সত্য শেখানো।”

তারপর আরিজ মাইক হাতে নেয়—
— “আমি যদি অপরাধের ফল হই, তবে আমি সেই অপরাধকেই পরিবর্তন করে মানবতার মুখ করবো।”

হল স্তব্ধ।



UNHCR পুনরায় বিবৃতি দেয়—“আমরা সহানুভূতিশীল পরিবার ও মানসিক পুনর্গঠনের এই মডেলকে সমর্থন করি।”

‘হতভাগা’ আরও বড় উদ্যোগ নেয়—শিশুদের জন্য ‘শিকড়’ প্রজেক্ট, যেখানে অবৈধ, অস্বীকৃত, গুম হওয়া বা পরিচয়হীন বাবা-মায়ের সন্তানদের পরিচয়-প্রাপ্তির এবং মানসিক শক্তি গঠনের কাজ হবে।

নাদিয়া আর আরিজ হাতে হাত রেখে হাঁটে—
সানজিদ দূর থেকে হাসে, এবং অন্ধকারের মধ্য থেকে ছায়া সরে যায়।


চলবে…
গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৮
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



0 Post a Comment:

Post a Comment