গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১১
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
এক সপ্তাহের মধ্যেই শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত তদন্ত সম্পন্ন হয়ে যায়। সংবাদপত্রে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় একে একে প্রকাশ হতে থাকে তার অপকর্মের প্রমাণ। শায়লা নিজের ভুল স্বীকার করতে না চাইলেও, তথ্যপ্রমাণে ফাঁস হয়ে যায় তার মিথ্যাচার।
নাদিয়া তার দলের সদস্যদের সাথে মিটিংয়ে বসে। সে জানত, শায়লার পতন শুধু তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নয়, বরং দেশের মানুষের জন্য এক বড় জয়। এবার তারা পুরো পৃথিবীকে দেখাতে পারবে যে, শিকড় প্রকল্প সত্যিকারের উন্নতি ও সচেতনতায় কাজ করছে।
"এটা আমাদের বিজয় নয়, এটা আমাদের সেই সমস্ত মানুষের বিজয় যারা প্রতিনিয়ত তাদের অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য লড়াই করছেন," নাদিয়া বলেছিল, তার মুখে দৃঢ়তার ছাপ।
এদিকে, শায়লা যখন পিছু হটে, তখন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একে একে তার সমস্ত অপরাধের বিচার শুরু হয়, এবং সে জানত, তার ক্ষমতার দিন শেষ।
নাদিয়া জানত, এই লড়াইয়ের শেষে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবে, তবে তার মনে এক অদৃশ্য ক্ষত রয়ে গেছে। শায়লার মতো মানুষের প্রতারণা সহজেই ভোলা যায় না। প্রজেক্টের কাজেও কিছু সময়ের জন্য অবাঞ্ছিত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
রাতের অন্ধকারে একদিন, নাদিয়া একা বসে ছিল। তার চোখে অশ্রু ছিল না, কিন্তু তার মন কিছুটা ভারী হয়ে উঠেছিল। এতদিন সে শুধু প্রকল্পের জন্য কাজ করেছে, কিন্তু আজ তাকে ভাবতে হয়েছিল তার নিজের জীবন, নিজের সন্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে। সবার চোখে তাকে যে অপরাধী হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনুভূতি তার জন্য একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে একটি নতুন দ্বন্দ্ব।
"এই মুহূর্তে আমি জানি না, আগামীকাল আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে," নাদিয়া মনে মনে ভাবছিল। "কিন্তু আমি জানি, আমি যেখানেই যাব, সঠিক পথেই যাব।"
একদিন, আরিজ তার মায়ের কাছে গিয়ে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিল—
“মা, তুমি তো সবকিছু জানো, আমাদের জীবন এত লড়াইয়ের পরও কেন আমি অন্যদের মতো সাধারণ হতে পারলাম না? কেন আমার জীবনটা এত কঠিন?”
নাদিয়া স্তম্ভিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আরিজের দিকে তাকিয়ে বলল—
"আরিজ, জীবন কখনো সহজ ছিল না। আর সহজ কিছু হঠাৎ আসে না। তুমি যেটা দেখেছো, সেটা শুধুমাত্র পরিশ্রম, বিশ্বাস, এবং সঠিক পথের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। তুমি যদি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে চাও, তুমি যদি অন্যদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চাও, তোমাকে কখনোই হাল ছাড়তে হবে না।"
আরিজ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে যেন এক নতুন আশা তৈরি হয়েছিল। সে জানত, তার মা নাদিয়া তাকে সঠিক পথ দেখাবে।
শায়লা রহমান যখন তার দুর্দশা বুঝতে পারে, তখন তার মধ্যে এক অদ্ভুত ভয় কাজ করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং তার অপকর্মের প্রকাশিত তথ্য তাকে একেবারে কোণঠাসা করে দেয়। একদিকে আদালতের চাপ, অন্যদিকে সমাজের তীব্র নিন্দা, শায়লা বুঝতে পারে যে তার সব কিছু এখন শেষ।
কিন্তু সে হাল ছাড়ে না। শায়লা জানত, তার শেষ সুযোগ হল, সে যদি নাদিয়ার সম্মান নিয়ে কিছু গড়তে পারে, তবেই তার কিছুটা প্রতিশোধ পাওয়া যাবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কেমন হবে? শায়লা কি নাদিয়াকে শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে পারবে? নাকি সব কিছু হারিয়ে ফেলে তাকে আরেকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে?
এদিকে, নাদিয়া ও তার প্রজেক্টের দল শিকড় প্রজেক্টের বিষয়ে আরো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে শুরু করেছিল। এরই মধ্যে তাদের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বব্যাপী সমর্থনও বেড়েছিল। নাদিয়া মিটিংয়ে একদিন বলেছিল—
"আমরা শুধু একটি সমাজ পরিবর্তন করতে চাই না, আমরা চাই পৃথিবীজুড়ে সমাজে একটা শক্তিশালী নৈতিক পরিবর্তন আসুক।"
অন্যদিকে, শায়লার অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের জাল আরও জটিল হয়ে যাচ্ছিল। তবে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একেবারে ভিন্ন। সে আসলে চেষ্টা করছিল সব কিছু নতুনভাবে গুছিয়ে নেওয়ার।
নাদিয়ার মনোভাব সেদিন থেকে একেবারে পরিবর্তিত হয়। শায়লার বিরুদ্ধে মামলা চালানো, সমস্ত ঘরবাড়ি পরিবর্তন করা, এইসব তাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে থাকে। শায়লা যখন তীব্র আঘাত দেয়, তখন নাদিয়া নিজের শক্তি অনুভব করে। নিজের পেশাদারিত্ব এবং নৈতিক অবস্থা ধরে রেখে, সে বুঝতে পারে, আসল শক্তি হচ্ছে বিশ্বাস।
এটা ছিল তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত—যেখানে সে নিজের সঠিক পথের দিকে এগিয়ে চলে, এবং এর মাধ্যমে পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয় যে, এক টুকরো আশা দিয়েও মানুষের জীবন পরিবর্তন করা সম্ভব।
এই মুহূর্তে নাদিয়া বুঝতে পারে, তার স্বপ্ন কেবল তার নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যাদের জীবন সংকটমুক্ত এবং সমান অধিকারী হতে পারে, তাদের। শিকড় প্রজেক্টের পরবর্তী ধাপ ছিল একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক উদ্যোগের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
নাদিয়া জানত, এই লড়াইয়ের পরবর্তী পর্যায় আরও কঠিন হবে, তবে সে কখনো হাল ছাড়বে না। একদিন তার প্রজেক্ট পুরো পৃথিবীকে পরিবর্তন করবে। সে দৃঢ়ভাবে জানত, তার সন্তান আরিজ এবং তার প্রজেক্ট একদিন সমাজে একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে।
চলবে......
0 Post a Comment:
Post a Comment