গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৬
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মাদ
শিকড় প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর পরেও নাদিয়ার মন আজ অস্থির।
আজ তার নিজের জীবনের ‘শিকড়’-এর কথা খুব মনে পড়ছে—তিন বছর আগে শাহিনুর বেগমের সেই থাপ্পড়, রায়হানের অন্ধ অবিশ্বাস, সমাজের থুতু ফেলা কথা—সবকিছু।
একদিন ভোরে সে গাড়ি নিয়ে বের হয়। উদ্দেশ্য—পুরোনো সেই বাড়ি, যেখানে একদিন সে ছিল ‘কলঙ্কিনী’।
ফিরে গিয়ে দেখে, সেই বাড়িটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। দরজায় কড়া নাড়লে একজন বৃদ্ধা বের হন—
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই মহিলা চোখে চশমা দিয়ে দেখে, মুখে হাত দিয়ে বলে—
“নাদিয়া? তুই?”
নাদিয়া তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা।
“তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস... আমি জানতাম, একদিন তুই আসবি। আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম মা। বিশ্বাস কর, আমি প্রতি রাতে কান্না করে ঘুমাই…”
নাদিয়া এবার উঠে এসে ওনার হাত ধরে বলে—
“আপনি মা ছিলেন, মা আছেন, থাকবেন। আমি চাই—এই বয়সে আপনি শান্তিতে থাকুন।”
শাহিনুর বেগম কাঁদেন, নাদিয়াকে বুকে টেনে নেন।
একটা সম্পর্ক, যেটা সমাজ ভেঙে দিতে চেয়েছিল, এখন ফিরছে ভালোবাসায়।
এইদিকে, আরিজ যখন নিজস্ব স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করছে—তখনই প্রযুক্তি খাতে কাজ করা এক প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে।
তারা দাবি করে, RootLink অ্যাপ এর কিছু তথ্য ব্যবহার করে গোপনে ‘ডেটা মাইনিং’ করা হয়েছে, যার কারণে আন্তর্জাতিক গোপনীয়তা আইনে মামলা হতে পারে।
আরিজ হতবাক।
তার কাজ স্বচ্ছ। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রে শিকড় প্রজেক্টের সুনামও বিপদের মুখে পড়ে।
নাদিয়া তখন নিজে এগিয়ে গিয়ে আরিজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে এক প্রেস কনফারেন্স করেন—
“একটি বীজ যত শক্তিও হোক, যদি তার উপর পচা মাটি ফেলা হয়, সে কেবল ধ্বংস হয়। আমরা চাই—এই বীজকে মাটি নয়, আলো দিক সমাজ।”
প্রেস কনফারেন্সে প্রযুক্তিবিদদের সমর্থন মেলে আরিজের পক্ষে। তদন্তে প্রমাণিত হয়, আরিজের অ্যাপ ১০০% স্বচ্ছ এবং কোনো তথ্য অপব্যবহার হয়নি।
ষড়যন্ত্র ভেঙে পড়ে।
তানহা, যিনি শুরু থেকে নাদিয়ার পাশে ছিল, এবার জীবনের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।
তার পরিবার চায় সে কানাডায় সেটল করুক। সেখানে একটি ভালো চাকরি, স্থায়ী নাগরিকত্ব—সব প্রস্তুত।
কিন্তু তানহা ভাবে—এই সমাজ, এই ‘শিকড়’ ছেড়ে কি সত্যিই যাওয়া যায়?
শেষমেশ সে নাদিয়াকে জানায়—
“তুই যদি বলিস, আমি থাকবো। আমি তোকে ফেলে যেতে চাই না।”
নাদিয়া হাসে।
“তুই যা। তোর ডানা আছে, তুই উড়। আমি জানি, তুই আবার ফিরবি। তুই গেলে তুই বড় হবি, আমরাও হবো।”
তানহার চোখে জল আসে। কিন্তু তাতে ভয় নেই—এই আলাদা হওয়াটা ত্যাগ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য পথ খুলে দেওয়া।
একদিন গভীর রাতে একটি মেইল আসে।
এক আন্তর্জাতিক NGO, যারা শিকড় প্রজেক্টের মডেল কপি করে নিজের নামে প্রচার করছে।
তাদের মূল উদ্দেশ্য—শিকড় নামটি কিনে নেওয়া এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।
নাদিয়া সেই মেইল দেখে হেসে ফেলে।
“আমার স্বপ্নের নাম কিনে নিতে চায়? স্বপ্ন কি টাকায় বিক্রি হয়?”
নাদিয়া এবার সরাসরি জাতিসংঘ ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার কাছে অভিযোগ করেন।
সাক্ষাৎকারে বলেন—
“আমরা কেবল ক্ষুধা নয়, আত্মার অভাব মেটাতে কাজ করি। ‘শিকড়’ কেবল প্রকল্প নয়—একটি মানুষের সম্মান ফিরে পাওয়ার গল্প।”
বিশ্বব্যাপী মানুষজন এই বক্তব্যে আবেগিত হয়।
#SaveShikor ট্রেন্ড করে।
অবশেষে ঐ NGO নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়।
এই পর্বের শেষ দিকে, নাদিয়া এক চিঠি পায়। পাঠিয়েছেন রায়হান। তাতে লেখা—
“তোমার ছেলেকে নিয়ে আমি গর্ব করি। আমি এখন বুঝি, এক সন্তানের পরিচয় তার রক্ত নয়, তার চেতনায়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই, যদি পারো, আমায় একটা সুযোগ দিও।”
নাদিয়া চিঠিটা পড়ে থাকে। পাশে বসে থাকা আরিজ বলে—
“মা, আমি যদি কখনো বাবাকে চিনতে চাই, তুমি কি বাধা দিবে?”
নাদিয়া বলে না, কেবল মাথা নাড়ে।
সময় যদি সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে, সময়ই চাইলে তা জোড়া লাগাতে পারে।
চলবে…
0 Post a Comment:
Post a Comment