গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৭
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে আরিজের জীবনে। এখন সে তরুণ উদ্যোক্তা, বিশ্বমঞ্চে স্বীকৃত নাম।
এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে সে মালয়েশিয়ায় যায়।
সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক বাঙালি বংশোদ্ভূত তরুণী—নেহা ইসলাম।
নেহা জন্মসূত্রে মালয়েশিয়ান হলেও, বাংলা বোঝে, বলে এবং হৃদয়ে বয়ে চলে তার শিকড়ের টান।
নেহার চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু কোথাও একটা চাপা বিষণ্ণতা।
কথা বলতে বলতে আরিজ টের পায়—এই মেয়েটা খুব স্বাভাবিক নয়। যেন কিছু লুকোচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের এক কাফেতে নেহা বলে—
“তুমি জানো আরিজ, আমি একদিন খুব ভুল করেছিলাম। কারো উপর ভরসা করেছিলাম, সে ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু এখন, তোমাকে দেখে আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।”
আরিজ চুপ থাকে। প্রথমবার, তার বুকের ভেতর একটা আলাদা অনুভূতি—মনে হয়, সে কারও দিকে একটু করে ঝুঁকছে।
আরিজ দেশে ফিরে আসে। কিন্তু বদলে গেছে। আগের মতো আর শিকড় প্রজেক্টে গভীর মনোযোগ দিতে পারছে না।
নাদিয়া তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে।
“তোর কি মন খারাপ? না কি... মন অন্য কোথাও?”
আরিজ হেসে এড়িয়ে যায়।
কিন্তু মা তো! মায়ের চোখ ফাঁকি যায় না।
এক রাতে, সে আরিজের রুমে ঢুকে দেখতে পায়—ডায়রির পাতায় লেখা—
“নেহা, তুমি কোথায়? আমার একলা পৃথিবীটা আজ তোমায় খুঁজছে।”
নাদিয়া অবাক হয় না। তবে চিন্তিত হয়। কারণ সে জানে—প্রেম কখনো কখনো তৈরি করে বিভ্রান্তি।
নেহার ফোন আসে একদিন।
সে জানায়, তার পরিবার তাকে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। সেই লোকটি নেহার বাবার ব্যাবসায়িক অংশীদার এবং খুবই ক্ষমতাবান।
“আমি পালিয়ে যেতে চাই, আরিজ। কিন্তু কোথায় যাবো?”
আরিজ এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই বলে—
“বাংলাদেশে চলে এসো। আমি আছি, তুমি একা নও।”
নাদিয়া সব শুনে বলেন—
“ছেলেকে আমি বন্ধ করতে চাই না। তবে চাই, সে বোঝে তার পছন্দটাই যেন তার পথের ছায়া না হয়।”
নেহা বাংলাদেশে আসে। মিডিয়াতে গুঞ্জন ওঠে—“শিকড় প্রজেক্টের উত্তরসূরি প্রেমে মাতোয়ারা”।
নাদিয়ার কিছু শুভানুধ্যায়ী শুরু করে ফিসফাস—“মা যেমন বিতর্কে জড়িয়েছিল, ছেলে কি সেই পথেই যাচ্ছে?”
একদিন এক রিপোর্টার সরাসরি নাদিয়াকে প্রশ্ন করে—
“আপনার ছেলে কি শিকড় প্রজেক্টকে ব্যক্তিগত প্রেমের প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ফেলছে?”
নাদিয়া কঠিন গলায় জবাব দেয়—
“প্রেম কখনো প্ল্যাটফর্ম হয় না। ওটা জীবনকে রঙ দেয়। তবে প্রেম যদি দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয়, তখনই সেটা বিপদ।”
আরিজ সব শুনে একদিন মায়ের রুমে আসে। চুপচাপ বসে থাকে।
“মা, আমি কি ভুল করছি?”
নাদিয়া বলে—
“ভুল প্রেম নয় আরিজ, ভুল সময় আর ভুল অঙ্গীকার। তুমি জানো, তোমার হৃদয়ের থেকেও বড় দায়িত্ব তোমার কাঁধে আছে। তুমি যদি ওকে ভালোবাসো, তবে ওকে সেই দায়িত্বের অংশ করো, বোঝা নয়।”
নেহার হাতে একদিন একটা চিঠি আসে।
চিঠিটা আরিজ লিখেছে—
“নেহা, আমি চাই তোমার স্বাধীনতা থাকুক, কিন্তু আমার পাশে থেকে।
যদি তুমি নিজেকে আমার সঙ্গে শিকড়ের পথে জড়াতে চাও—তবে তুমি আসো।
আর যদি তুমি ভেবো, আমি তোমার উড়তে বাধা হবো—তবে আমার ভালোবাসায় উড়েই যেও।”
নেহা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। চোখে জল।
তার উত্তর:
“আমি আসবো। আমি শুধু প্রেম নয়, দায়িত্ব নিয়েই তোমার পাশে থাকতে চাই। এবার থেকে আমার পরিচয়, শিকড়ের এক সহযাত্রী।”
শিকড় প্রজেক্টে এক নতুন বিভাগ খোলা হয়—“নারী উদ্যোক্তা প্ল্যাটফর্ম”।
নেহা তার হেড।
আরিজ ও সে একসঙ্গে দায়িত্ব নেয়।
নাদিয়া দূর থেকে দেখে, তার ছেলেটা আজ পথ দেখাচ্ছে।
একদিন রাতে সে ডায়েরিতে লেখে—
“হতভাগা ছিলাম, আজ হয়তো তা-ই। কিন্তু ভাগ্য যদি এত বড় করে দেয় আমার ‘অভাগ্য’কে—তবে তা-ই আমার গর্ব।”
চলবে...
0 Post a Comment:
Post a Comment