গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৮
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
শিকড় প্রজেক্টের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, তখনই ছায়ার মতো নেমে আসে এক অজানা ষড়যন্ত্র।
সরকারি এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন উঠে আসে—“শিকড় প্রজেক্ট বিদেশি অর্থায়নে দেশের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা চালাচ্ছে”।
একটানা দুই দিন দেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল এবং পত্রিকা শিরোনাম করে:
“দেশবিরোধী ‘শিকড়’? তদন্তে গোয়েন্দারা!”
আরিজ হতবাক।
প্রতিটি ডকুমেন্ট স্বচ্ছ, প্রতিটি লেনদেন বৈধ।
তবু কিভাবে এই অভিযোগ?
নাদিয়া বুঝে ফেলে, এটা শুধু প্রজেক্টের বিরুদ্ধে নয়, বরং আরিজকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার চেষ্টা।
একদিন রাতে সে আরিজকে ডেকে বলে—
“এই যে তোমার জনপ্রিয়তা, এটা সবার সহ্য হয় না। দেশের মাটিতে বড় হতে গেলে, মাটির পোকাও কামড়ায়।”
আরিজ চুপচাপ শোনে।
“মা, আমি কিছু লুকাইনি। কিন্তু এরা এত ঘৃণা কেন করে?”
নাদিয়া হালকা হাসে—
“কারণ তুই ‘হতভাগা’র সন্তান। ভাগ্য তোর পেছনে দাঁড়ায়নি, তুই ভাগ্যকে সামনে এনেছিস।”
এদিকে এক সাংবাদিক ‘নাদিয়া রহমান’-এর অতীত খুঁজে বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করে,
নাদিয়ার সন্তান আরিজ—তাকে জন্ম দিয়েছিলেন এক নিঃসঙ্গ মহিলা, কিন্তু কোনো স্বীকৃতি ছিল না সেই সময়।
গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে:
“নাদিয়ার সন্তান অবৈধ? কে আরিজের পিতা?”
শব্দগুলো কুরুচিকর, কাঁটার মতো বিঁধে যায় আরিজের গায়ে।
নাদিয়া চুপ করে থাকে।
তবে আরিজ চুপ করে না।
এক প্রেস কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে সে বলে—
“আমার পরিচয় আমি। আমার জন্ম, আমার মা—সে আমার পৃথিবী। পিতার পরিচয় না থাকলেও, আমার রক্তে কলঙ্ক নেই। যদি সমাজ একা মাকে প্রশ্ন করে, তাহলে সমাজই কলঙ্কিত।”
তথ্য দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে, তার সাহস দিয়ে—আরিজ জনমনে আসন গড়ে।
নেহা, যে এতদিন চুপ ছিল, সামনে আসে।
একটি টেলিভিশন টকশোতে বলে—
“আমি আরিজের সহধর্মিণী নই, কিন্তু সহযোদ্ধা।
শিকড় প্রজেক্ট কারো বিরুদ্ধে নয়। এটি আমাদের সংস্কৃতির আয়না, শেকড়ের অনুসন্ধান।
যে শিকড় বোঝে না, সে কখনো ডালপালা গজায় না।”
এই বক্তব্য ভাইরাল হয়।
সমর্থন আসতে থাকে দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে।
শুধু তরুণ সমাজ নয়, প্রবীণরাও বুঝতে শুরু করে—শিকড় প্রকল্প আসলে একটি আত্ম-অনুসন্ধান।
এ সময় এক রহস্যময় মানুষ আসে নাদিয়ার সামনে।
নাম—রেজা করিম। বয়স ষাট পেরিয়েছে।
সে বলে—
“আমি ইউরোপ থেকে ফিরেছি, বহু বছর পর। আমি একজন গবেষক, এবং... আমি তোমার পুরোনো চেনা। মনে পড়ে?”
নাদিয়া থমকে যায়।
এই রেজা করিমই ছিল একসময় তার সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেম।
তিনিই একসময় তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গোপনে, যখন সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
রেজা বলেন—
“তোমার ছেলের কথা শুনে ফিরে এসেছি। এই সময় তোমার পাশে না দাঁড়ালে আমি মানুষ থাকব না।”
সবকিছু কাটিয়ে, একদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়—শিকড় সম্মেলন ২০২৫।
প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি।
আরিজ বক্তব্য দেয়—
“আমি নাদিয়ার ছেলে, একজন ‘হতভাগা’ মায়ের সন্তান।
কিন্তু আমার মা-ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য।
আজ যারা প্রশ্ন করেছে, আমি তাদের ক্ষমা করি। কারণ তারা জানে না, একা মায়েরা কতটা শক্ত।
এই প্রজেক্ট তাদের জন্য, যারা হারিয়ে যাওয়া পরিচয়ের খোঁজে মরিয়া।”
হলজুড়ে করতালি। নাদিয়ার চোখে জল।
রেজা করিম এক কোণায় দাঁড়িয়ে, নিরবে সম্মান জানায় অতীতের প্রেমকে।
প্রেম, পরিচয়, সমাজের যন্ত্রণা—সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ‘হতভাগা’র গল্প দাঁড়ায় এক মহাকাব্যে।
তবে এখানেই শেষ নয়।
চলবে....
0 Post a Comment:
Post a Comment