গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৫
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ
নাদিয়া যখন ব্যস্ত শিকড় প্রজেক্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনের প্রস্তুতিতে, ঠিক তখনই একদিন ডাকযোগে একটি বিশেষ আমন্ত্রণপত্র আসে। এটি ছিল ইউনেস্কো থেকে, প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া “Global Roots & Humanity” সম্মেলনের জন্য। সেখানে সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করা ৫টি মানবিক প্রকল্পকে সম্মাননা দেওয়া হবে।
শিকড় প্রজেক্ট তার মধ্যে একটি।
এই সংবাদ শুনে পুরো টিম উৎফুল্ল হয়ে উঠে, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল—এই সম্মেলনের বিচারকদের একজন হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি একসময় শায়লার সাথে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট গ্রুপে কাজ করতেন, এবং শায়লার প্রভাব থাকায় নাদিয়ার প্রজেক্টকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সময়ের আবর্তে সেই ব্যক্তিও এখন মানবিকতার পথে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
নাদিয়া অনুভব করল, সময়ই মানুষের সবচেয়ে বড় বিচারক।
আরিজ তার নতুন অ্যাপ্লিকেশন “RootLink” তৈরি করে ফেলেছে, যেটি দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের মানুষদের শিকড় প্রজেক্টের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে সাহায্য করে। এই অ্যাপে একদিকে যেমন উন্নয়ন প্রকল্পের খবর জানা যায়, তেমনি মানুষ চাইলে নিজ নিজ এলাকার চাহিদাও জানাতে পারে।
ইউনেস্কোর সম্মেলনে আরিজের আবিষ্কার বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিবিদ ও সমাজকর্মীরা তার কাজ দেখে বিস্মিত হয়।
সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নাদিয়া বলে—
“মানবিক উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়। শিকড় প্রজেক্ট একটি পথ মাত্র—যেখানে আমরা সবাই একে অপরের জন্য কাজ করি।”
তার বক্তব্যে হলজুড়ে দাঁড়িয়ে তালি পড়ে।
প্যারিসে থাকাকালীন, এক রাতে হোটেল লবিতে নাদিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় একজন চেনা মুখ—রায়হান।
তিন বছর পর।
নিরবতা।
দীর্ঘক্ষণ কেউ কিছু বলেনা।
অবশেষে রায়হান বলল—
“তোমার জয় দেখে গর্ব হচ্ছে, নাদিয়া। অথচ… আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমিই একদিন তোমায় অপমান করে চলে গিয়েছিলাম।”
নাদিয়া চোখ নামিয়ে বলল—
“বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। কেবল একটাই প্রশ্ন রেখেছিলাম বারবার নিজের কাছে—‘আমি কি সত্যিই এতটা অযোগ্য ছিলাম যে, কেউ না শুনেই আমাকে কলঙ্কিনী বলবে?’”
রায়হান মাথা নিচু করে। তার চোখে অনুশোচনা।
“আমি এখন বুঝি… আমরা সমাজের ভাষায় বিচার করতে গিয়ে অনেক সময় ভালোবাসাকেও ভুলে যাই।”
এই মুহূর্তে নাদিয়া জানে, ক্ষমা করা শক্তি। কিন্তু সে কোনো সম্পর্ক ফিরিয়ে নিতে চায় না। সে এবার তার ‘অস্তিত্ব’ নিয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।
ঢাকায় ফেরার পর খবর আসে—শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হয়েছে। তার দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মিডিয়া শায়লার পতনকে শিরোনামে তুলে ধরে।
আর এই সময়েই শিকড় প্রজেক্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথেও চুক্তি করে। যার ফলে উন্নয়নমূলক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
একদিন রাতে সংবাদে শায়লার মুখটা দেখে নাদিয়া চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে করুণা।
তানহা পাশে এসে বলে—
“তুমি যদি তখন তার পথে হাটতে, আজ হয়তো তিনিও তোমার মত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি হারিয়ে গেছেন প্রতিশোধ আর অহংকারে।”
নাদিয়া জানে, প্রতিশোধ নয়—প্রেম, ক্ষমা, আর দায়বদ্ধতাই মানুষকে সত্যিকারের বিজয় এনে দেয়।
শিকড় প্রজেক্ট এবার শিশুদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম চালু করে—“জন্মাধিকার” নামে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে পথশিশু, অনাথ, কিংবা অবহেলিত শিশুদের সুশিক্ষা ও পিতৃত্ব-মাতৃত্বের অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
নাদিয়ার সন্তান, আরিজ, সেই কার্যক্রমের প্রতীক হয়ে ওঠে।
একদিন এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলো—
“তুমি একদিন এই প্রকল্পের জন্য পরিচিত হবে কি মা নাদিয়ার সন্তান হিসেবে? নাকি নিজের কাজের জন্য?”
আরিজ হাসলো—
“আমি গর্বিত যে মা নাদিয়া আমার মা। কিন্তু আমি চাই, আমার কাজ আমাকে আলাদা পরিচয় দিক। যেমন মা চেয়েছিলেন, আমি যেন নিজের পথ নিজে তৈরি করি।”
এই পর্বের শেষ দিকে নাদিয়ার হাতে আসে একটি চিঠি। এটি এসেছে আফ্রিকার একটি ছোট গ্রাম থেকে, যেখানে শিকড় প্রজেক্ট সম্প্রতি একটি স্কুল স্থাপন করেছে।
চিঠির মধ্যে লেখা:
“আমরা জানতাম না পৃথিবীতে কেউ আমাদের কথা ভাবে। আপনি সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আমাদের নাম দিয়েছেন—‘মানুষ’ হিসেবে। আমাদের শিশুদের হাতে বই, মুখে হাসি আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আপনি দিয়েছেন। আপনি আমাদের ‘মা নাদিয়া’।”
নাদিয়ার চোখে জল আসে।
এই নামটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়—
মা নাদিয়া।
চলবে...
0 Post a Comment:
Post a Comment