গল্প: হতভাগা পর্ব: ২০ (শেষ পর্ব) শিরোনাম: ‘হতভাগা’ নয়, ‘জয়িনী’ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ





 গল্প: হতভাগা

পর্ব: ২০ (শেষ পর্ব)
শিরোনাম: ‘হতভাগা’ নয়, ‘জয়িনী’
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



ঢাকার কুর্মিটোলা মিলনায়তনে জমকালো এক আয়োজন।
জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি মেলা
মঞ্চের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে এক বিশাল ব্যানার—
“শিকড়: আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম”

অতিথি, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিজন—সবাই গুনছে সময়।
প্রধান বক্তা আজ—নেহা রহমান।
আরিজ এখন আফ্রিকায়, জাতিসংঘের অধীন ‘সাসটেইনেবল কালচার প্রজেক্ট’-এর মুখ।

নেহা স্টেজে উঠে বলে—

“যে মাটি আমাদের জন্ম দেয়, আমরা তাকে ভুলে যাই।
আর কেউ কেউ, সেই মাটিকে ভালোবেসে বুকে আগুন বয়ে বেড়ায়।
আমি এমন একজনকে দেখেছি—নাদিয়া রহমান।
আজ তার সন্তানের সাফল্য আমাদের সবার জয়।”

হলজুড়ে করতালি।
নাদিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। কেউ একজন বলে—
“এই তো সেই মা, যাকে একদিন সমাজ ছুঁড়ে ফেলেছিল!”



রুবিনার মিথ্যাচার, ভিডিও এডিটিং এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টার সব প্রমাণ বেরিয়ে আসে।

স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রকাশ করে—

“যে নারী এক মাকে সমাজচ্যুত করতে চেয়েছিল, সে-ই আজ নিজের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।”

নাদিয়া কোথাও কোনো প্রতিশোধ নেয় না।
এক প্রেস বিবৃতিতে শুধু বলেন—

“ক্ষমা করতে পারা দুর্বলতা নয়। প্রতিশোধ না নিয়ে শান্ত থাকা মানেই আত্মিক শক্তি।”



আরিজ আফ্রিকা থেকে নিয়মিত মাকে চিঠি লিখে।
একটি চিঠিতে সে লেখে—

“মা, এখানে যখন কেউ নিজের শেকড়ের গল্প বলে, তখন আমি তোদের কথা বলি।
বলে দেই, আমি সেই ছেলেটা, যার মা একা হাতে একটি সমাজকে পরাজিত করেছিল।”

নাদিয়া সেই চিঠিগুলো যত্ন করে রাখেন।
একটি ছোট কাঠের বাক্সে—যেন স্মৃতির সৌধ।



একদিন সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত হয়—
‘জাতীয় নারী শক্তি সম্মাননা’

এবছর এই পুরস্কার পাচ্ছেন—নাদিয়া রহমান

পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তে নাদিয়া বলে—

“একটা সময় আমি ছিলাম ‘হতভাগা’।
আজ এই পরিচয়ে দাঁড়ানো—আমার নয়, সমস্ত একা মায়ের জয়।
যে মা সন্তানের পাশে থাকে, সে মা জাতির আলোকবর্তিকা।”

এই মুহূর্তে উপস্থিত এক সাংবাদিক বলে ফেলেন—

“আজকের পর থেকে কেউ তাকে ‘হতভাগা’ বলবে না। সে এক ‘জয়িনী’ মা।”



এক বছরের মাথায় আরিজ দেশে ফেরে।
নেহা তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করে।
পাশে দাঁড়িয়ে নাদিয়া—শাড়িতে, চোখে জ্যোতি।

আরিজ মাকে দেখে বলে—

“তুমি কাঁদছো মা?”

নাদিয়া মাথা নাড়ে—

“না, আমি হাসছি। তুই ফিরে আসলি, এটাই তো আমার ভাগ্য।”

আরিজ মাকে জড়িয়ে ধরে।

পেছনে ক্যামেরা, সাংবাদিক, আলোকপাত।
কিন্তু এই মায়ের কাছে সবটাই ম্লান।



একজন মা, যাকে সমাজ একদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল,
সেই মা-ই দাঁড়িয়ে আছেন সন্তানের হাত ধরে গর্বে মাথা উঁচু করে

“হতভাগা” শব্দটা এখন কেবল একটা পুরনো খোলস, যার ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে এক নতুন আলোর নাম—
“জয়িনী”।


সমাপ্ত।

ধন্যবাদ, এই দীর্ঘযাত্রায় সঙ্গ দেওয়ার জন্য। 

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৯ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 





গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১৯
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



যখন শিকড় প্রজেক্ট আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে, যখন মনে হচ্ছিল ঝড় পেরিয়ে সূর্যের দেখা মিলেছে—ঠিক তখনই আবার ফিরে আসে এক পুরনো ছায়া।

রুবিনা, সেই প্রতিবেশী, যে একসময় নাদিয়াকে কলঙ্কিনী বলেছিল—সে ফিরে এসেছে, কিন্তু এবার ক্ষমা চেয়ে নয়।

রুবিনা এখন এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
তার অবস্থান, ক্ষমতা—সবকিছুই বেড়েছে।
কিন্তু মনের বিষাক্ততা কমেনি।

সে স্থানীয় মিডিয়াকে বলে—

“আমি একসময় সত্য বলেছিলাম, সবাই আমায় দোষ দিলো। এখন প্রমাণ করেছি, আমার সন্দেহ ঠিক ছিল। এমন পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নয়।”

নাদিয়া বিষয়টা হজম করতে পারেন না।
কিন্তু এবার আর চুপ থাকেন না।

তিনি সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন—

“আপনারা যাদের কাদা ছুঁড়ে মারছেন, তাদের পেছনে পাহাড়ের মতো লড়াইয়ের গল্প থাকে। একা মায়ের সংগ্রামকে ছোট করে দেখতে গেলে, আপনি মানুষ নন।”



নেহা ও আরিজের সম্পর্কেও টানাপোড়েন শুরু হয়।
কারণ, নেহা জানতে পারে—এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, “ফিউচার রুটস”, আরিজকে এক নতুন প্রকল্পের নেতৃত্বে ডাকছে, যার জন্য দুই বছর তাকে আফ্রিকায় থাকতে হবে

নেহা বলে—

“তুমি চলে গেলে, শিকড় কে সামলাবে? আমি কি প্রস্তুত?”

আরিজ বলে—

“তুমি পারবে। কারণ তুমি শুধু আমার ভালোবাসা নও, তুমি আমার জায়গায় দাঁড়ানোর যোগ্য।”

নেহা দ্বিধায় পড়ে যায়। ভালোবাসা একপাশে, দায়িত্ব অন্যপাশে।



ঠিক সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে একটি এডিট করা ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে নাদিয়া নাকি এক সময় বিদেশি ডোনারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে শর্তে রাজি হয়েছিল—“দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণদের পরিচালিত করবে”।

ভিডিওটি ভুয়া, তবে এত নিখুঁতভাবে বানানো যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

জাতীয় তদন্ত সংস্থা হস্তক্ষেপ করে।
নাদিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।

আরিজ বিদেশ যাত্রা স্থগিত করে।



রেজা করিম সামনে আসে।
সে প্রমাণ দেয়, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে এক বড় কর্পোরেট লবি, যারা ‘শিকড়’ প্রকল্পকে বন্ধ করতে চায়—কারণ এর প্রভাবে তরুণরা বিদেশি পণ্য, চিন্তা ও নির্ভরশীলতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে রেজা বলে—

“তারা ভয় পায়—এক মা আর তার সন্তান যদি শিকড় খুঁজে পায়, তাহলে তারা আর বিভ্রান্ত হবে না।”

এই বক্তব্য আবারও সমাজে আলোড়ন তোলে।



নেহা সবকিছু দেখে আরিজকে জড়িয়ে ধরে বলে—

“আমি ভেবেছিলাম দূরে গেলে সম্পর্ক হারিয়ে যাবে।
এখন বুঝলাম—এই সম্পর্ক যদি সত্য হয়, তবে দূরত্ব কোনো দেয়াল নয়, সেতু।”

সে সিদ্ধান্ত নেয়, শিকড়ের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার সে নিজে সামলাবে।
আরিজ আফ্রিকায় যাবে, বিশ্বমঞ্চে দেশের প্রতিনিধি হয়ে।



নাদিয়া তার ডায়েরির পাতায় লেখে—

“এই যুদ্ধ থামেনি, থামবেও না।
একদিন আমি ছিলাম 'হতভাগা', আজ আমার সন্তান 'আলোকধারা'।
এক মা যদি সমাজের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তবে সে শুধুই মা নয়—সে এক জাতির প্রতিচ্ছবি।”



আরিজ প্লেনে ওঠার সময়, মায়ের কানে ফিসফিস করে বলে—

“মা, আমি ফিরে আসবো। নতুন আলো নিয়ে। ততদিন তুমি জ্বলে থাকো আমার শিখা হয়ে।”

নাদিয়া জানালায় দাঁড়িয়ে শুধু বলেন—

“আমার গর্ভের সন্তান, আমার অহংকার।”


চলবে...

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৮ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 

গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৮
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

শিকড় প্রজেক্টের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, তখনই ছায়ার মতো নেমে আসে এক অজানা ষড়যন্ত্র।
সরকারি এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন উঠে আসে—“শিকড় প্রজেক্ট বিদেশি অর্থায়নে দেশের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা চালাচ্ছে”

একটানা দুই দিন দেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল এবং পত্রিকা শিরোনাম করে:

“দেশবিরোধী ‘শিকড়’? তদন্তে গোয়েন্দারা!”

আরিজ হতবাক।
প্রতিটি ডকুমেন্ট স্বচ্ছ, প্রতিটি লেনদেন বৈধ।
তবু কিভাবে এই অভিযোগ?



নাদিয়া বুঝে ফেলে, এটা শুধু প্রজেক্টের বিরুদ্ধে নয়, বরং আরিজকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার চেষ্টা।

একদিন রাতে সে আরিজকে ডেকে বলে—

“এই যে তোমার জনপ্রিয়তা, এটা সবার সহ্য হয় না। দেশের মাটিতে বড় হতে গেলে, মাটির পোকাও কামড়ায়।”

আরিজ চুপচাপ শোনে।

“মা, আমি কিছু লুকাইনি। কিন্তু এরা এত ঘৃণা কেন করে?”

নাদিয়া হালকা হাসে—

“কারণ তুই ‘হতভাগা’র সন্তান। ভাগ্য তোর পেছনে দাঁড়ায়নি, তুই ভাগ্যকে সামনে এনেছিস।”



এদিকে এক সাংবাদিক ‘নাদিয়া রহমান’-এর অতীত খুঁজে বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করে,
নাদিয়ার সন্তান আরিজ—তাকে জন্ম দিয়েছিলেন এক নিঃসঙ্গ মহিলা, কিন্তু কোনো স্বীকৃতি ছিল না সেই সময়।

গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে:

“নাদিয়ার সন্তান অবৈধ? কে আরিজের পিতা?”

শব্দগুলো কুরুচিকর, কাঁটার মতো বিঁধে যায় আরিজের গায়ে।
নাদিয়া চুপ করে থাকে।

তবে আরিজ চুপ করে না।

এক প্রেস কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে সে বলে—

“আমার পরিচয় আমি। আমার জন্ম, আমার মা—সে আমার পৃথিবী। পিতার পরিচয় না থাকলেও, আমার রক্তে কলঙ্ক নেই। যদি সমাজ একা মাকে প্রশ্ন করে, তাহলে সমাজই কলঙ্কিত।”

তথ্য দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে, তার সাহস দিয়ে—আরিজ জনমনে আসন গড়ে।

নেহা, যে এতদিন চুপ ছিল, সামনে আসে।
একটি টেলিভিশন টকশোতে বলে—

“আমি আরিজের সহধর্মিণী নই, কিন্তু সহযোদ্ধা।
শিকড় প্রজেক্ট কারো বিরুদ্ধে নয়। এটি আমাদের সংস্কৃতির আয়না, শেকড়ের অনুসন্ধান।
যে শিকড় বোঝে না, সে কখনো ডালপালা গজায় না।”

এই বক্তব্য ভাইরাল হয়।
সমর্থন আসতে থাকে দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে।
শুধু তরুণ সমাজ নয়, প্রবীণরাও বুঝতে শুরু করে—শিকড় প্রকল্প আসলে একটি আত্ম-অনুসন্ধান।



এ সময় এক রহস্যময় মানুষ আসে নাদিয়ার সামনে।

নাম—রেজা করিম। বয়স ষাট পেরিয়েছে।

সে বলে—

“আমি ইউরোপ থেকে ফিরেছি, বহু বছর পর। আমি একজন গবেষক, এবং... আমি তোমার পুরোনো চেনা। মনে পড়ে?”

নাদিয়া থমকে যায়।

এই রেজা করিমই ছিল একসময় তার সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেম।
তিনিই একসময় তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গোপনে, যখন সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

রেজা বলেন—

“তোমার ছেলের কথা শুনে ফিরে এসেছি। এই সময় তোমার পাশে না দাঁড়ালে আমি মানুষ থাকব না।”



সবকিছু কাটিয়ে, একদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়—শিকড় সম্মেলন ২০২৫
প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি।

আরিজ বক্তব্য দেয়—

“আমি নাদিয়ার ছেলে, একজন ‘হতভাগা’ মায়ের সন্তান।
কিন্তু আমার মা-ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য।
আজ যারা প্রশ্ন করেছে, আমি তাদের ক্ষমা করি। কারণ তারা জানে না, একা মায়েরা কতটা শক্ত।
এই প্রজেক্ট তাদের জন্য, যারা হারিয়ে যাওয়া পরিচয়ের খোঁজে মরিয়া।”

হলজুড়ে করতালি। নাদিয়ার চোখে জল।
রেজা করিম এক কোণায় দাঁড়িয়ে, নিরবে সম্মান জানায় অতীতের প্রেমকে।



প্রেম, পরিচয়, সমাজের যন্ত্রণা—সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ‘হতভাগা’র গল্প দাঁড়ায় এক মহাকাব্যে।

তবে এখানেই শেষ নয়।

চলবে....

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৭ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 

গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৭
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে আরিজের জীবনে। এখন সে তরুণ উদ্যোক্তা, বিশ্বমঞ্চে স্বীকৃত নাম।
এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে সে মালয়েশিয়ায় যায়।

সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক বাঙালি বংশোদ্ভূত তরুণী—নেহা ইসলাম
নেহা জন্মসূত্রে মালয়েশিয়ান হলেও, বাংলা বোঝে, বলে এবং হৃদয়ে বয়ে চলে তার শিকড়ের টান।

নেহার চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু কোথাও একটা চাপা বিষণ্ণতা।
কথা বলতে বলতে আরিজ টের পায়—এই মেয়েটা খুব স্বাভাবিক নয়। যেন কিছু লুকোচ্ছে।

এক সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের এক কাফেতে নেহা বলে—

“তুমি জানো আরিজ, আমি একদিন খুব ভুল করেছিলাম। কারো উপর ভরসা করেছিলাম, সে ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু এখন, তোমাকে দেখে আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।”

আরিজ চুপ থাকে। প্রথমবার, তার বুকের ভেতর একটা আলাদা অনুভূতি—মনে হয়, সে কারও দিকে একটু করে ঝুঁকছে।



আরিজ দেশে ফিরে আসে। কিন্তু বদলে গেছে। আগের মতো আর শিকড় প্রজেক্টে গভীর মনোযোগ দিতে পারছে না।

নাদিয়া তার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে।

“তোর কি মন খারাপ? না কি... মন অন্য কোথাও?”

আরিজ হেসে এড়িয়ে যায়।

কিন্তু মা তো! মায়ের চোখ ফাঁকি যায় না।

এক রাতে, সে আরিজের রুমে ঢুকে দেখতে পায়—ডায়রির পাতায় লেখা—

“নেহা, তুমি কোথায়? আমার একলা পৃথিবীটা আজ তোমায় খুঁজছে।”

নাদিয়া অবাক হয় না। তবে চিন্তিত হয়। কারণ সে জানে—প্রেম কখনো কখনো তৈরি করে বিভ্রান্তি।



নেহার ফোন আসে একদিন।

সে জানায়, তার পরিবার তাকে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। সেই লোকটি নেহার বাবার ব্যাবসায়িক অংশীদার এবং খুবই ক্ষমতাবান।

“আমি পালিয়ে যেতে চাই, আরিজ। কিন্তু কোথায় যাবো?”

আরিজ এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই বলে—

“বাংলাদেশে চলে এসো। আমি আছি, তুমি একা নও।”

নাদিয়া সব শুনে বলেন—

“ছেলেকে আমি বন্ধ করতে চাই না। তবে চাই, সে বোঝে তার পছন্দটাই যেন তার পথের ছায়া না হয়।”



নেহা বাংলাদেশে আসে। মিডিয়াতে গুঞ্জন ওঠে—“শিকড় প্রজেক্টের উত্তরসূরি প্রেমে মাতোয়ারা”

নাদিয়ার কিছু শুভানুধ্যায়ী শুরু করে ফিসফাস—“মা যেমন বিতর্কে জড়িয়েছিল, ছেলে কি সেই পথেই যাচ্ছে?”

একদিন এক রিপোর্টার সরাসরি নাদিয়াকে প্রশ্ন করে—

“আপনার ছেলে কি শিকড় প্রজেক্টকে ব্যক্তিগত প্রেমের প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ফেলছে?”

নাদিয়া কঠিন গলায় জবাব দেয়—

“প্রেম কখনো প্ল্যাটফর্ম হয় না। ওটা জীবনকে রঙ দেয়। তবে প্রেম যদি দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয়, তখনই সেটা বিপদ।”

আরিজ সব শুনে একদিন মায়ের রুমে আসে। চুপচাপ বসে থাকে।

“মা, আমি কি ভুল করছি?”

নাদিয়া বলে—

“ভুল প্রেম নয় আরিজ, ভুল সময় আর ভুল অঙ্গীকার। তুমি জানো, তোমার হৃদয়ের থেকেও বড় দায়িত্ব তোমার কাঁধে আছে। তুমি যদি ওকে ভালোবাসো, তবে ওকে সেই দায়িত্বের অংশ করো, বোঝা নয়।”



নেহার হাতে একদিন একটা চিঠি আসে।
চিঠিটা আরিজ লিখেছে—

“নেহা, আমি চাই তোমার স্বাধীনতা থাকুক, কিন্তু আমার পাশে থেকে।
যদি তুমি নিজেকে আমার সঙ্গে শিকড়ের পথে জড়াতে চাও—তবে তুমি আসো।
আর যদি তুমি ভেবো, আমি তোমার উড়তে বাধা হবো—তবে আমার ভালোবাসায় উড়েই যেও।”

নেহা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। চোখে জল।

তার উত্তর:

“আমি আসবো। আমি শুধু প্রেম নয়, দায়িত্ব নিয়েই তোমার পাশে থাকতে চাই। এবার থেকে আমার পরিচয়, শিকড়ের এক সহযাত্রী।”



শিকড় প্রজেক্টে এক নতুন বিভাগ খোলা হয়—“নারী উদ্যোক্তা প্ল্যাটফর্ম”
নেহা তার হেড।
আরিজ ও সে একসঙ্গে দায়িত্ব নেয়।

নাদিয়া দূর থেকে দেখে, তার ছেলেটা আজ পথ দেখাচ্ছে।

একদিন রাতে সে ডায়েরিতে লেখে—

“হতভাগা ছিলাম, আজ হয়তো তা-ই। কিন্তু ভাগ্য যদি এত বড় করে দেয় আমার ‘অভাগ্য’কে—তবে তা-ই আমার গর্ব।”


চলবে...

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৬ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 

গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৬
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মাদ

শিকড় প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর পরেও নাদিয়ার মন আজ অস্থির।
আজ তার নিজের জীবনের ‘শিকড়’-এর কথা খুব মনে পড়ছে—তিন বছর আগে শাহিনুর বেগমের সেই থাপ্পড়, রায়হানের অন্ধ অবিশ্বাস, সমাজের থুতু ফেলা কথা—সবকিছু।

একদিন ভোরে সে গাড়ি নিয়ে বের হয়। উদ্দেশ্য—পুরোনো সেই বাড়ি, যেখানে একদিন সে ছিল ‘কলঙ্কিনী’।

ফিরে গিয়ে দেখে, সেই বাড়িটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। দরজায় কড়া নাড়লে একজন বৃদ্ধা বের হন—

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই মহিলা চোখে চশমা দিয়ে দেখে, মুখে হাত দিয়ে বলে—

“নাদিয়া? তুই?”

নাদিয়া তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা।

“তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস... আমি জানতাম, একদিন তুই আসবি। আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম মা। বিশ্বাস কর, আমি প্রতি রাতে কান্না করে ঘুমাই…”

নাদিয়া এবার উঠে এসে ওনার হাত ধরে বলে—

“আপনি মা ছিলেন, মা আছেন, থাকবেন। আমি চাই—এই বয়সে আপনি শান্তিতে থাকুন।”

শাহিনুর বেগম কাঁদেন, নাদিয়াকে বুকে টেনে নেন।

একটা সম্পর্ক, যেটা সমাজ ভেঙে দিতে চেয়েছিল, এখন ফিরছে ভালোবাসায়।



এইদিকে, আরিজ যখন নিজস্ব স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করছে—তখনই প্রযুক্তি খাতে কাজ করা এক প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে।

তারা দাবি করে, RootLink অ্যাপ এর কিছু তথ্য ব্যবহার করে গোপনে ‘ডেটা মাইনিং’ করা হয়েছে, যার কারণে আন্তর্জাতিক গোপনীয়তা আইনে মামলা হতে পারে।

আরিজ হতবাক।

তার কাজ স্বচ্ছ। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রে শিকড় প্রজেক্টের সুনামও বিপদের মুখে পড়ে।

নাদিয়া তখন নিজে এগিয়ে গিয়ে আরিজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে এক প্রেস কনফারেন্স করেন—

“একটি বীজ যত শক্তিও হোক, যদি তার উপর পচা মাটি ফেলা হয়, সে কেবল ধ্বংস হয়। আমরা চাই—এই বীজকে মাটি নয়, আলো দিক সমাজ।”

প্রেস কনফারেন্সে প্রযুক্তিবিদদের সমর্থন মেলে আরিজের পক্ষে। তদন্তে প্রমাণিত হয়, আরিজের অ্যাপ ১০০% স্বচ্ছ এবং কোনো তথ্য অপব্যবহার হয়নি।

ষড়যন্ত্র ভেঙে পড়ে।



তানহা, যিনি শুরু থেকে নাদিয়ার পাশে ছিল, এবার জীবনের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।
তার পরিবার চায় সে কানাডায় সেটল করুক। সেখানে একটি ভালো চাকরি, স্থায়ী নাগরিকত্ব—সব প্রস্তুত।

কিন্তু তানহা ভাবে—এই সমাজ, এই ‘শিকড়’ ছেড়ে কি সত্যিই যাওয়া যায়?

শেষমেশ সে নাদিয়াকে জানায়—

“তুই যদি বলিস, আমি থাকবো। আমি তোকে ফেলে যেতে চাই না।”

নাদিয়া হাসে।

“তুই যা। তোর ডানা আছে, তুই উড়। আমি জানি, তুই আবার ফিরবি। তুই গেলে তুই বড় হবি, আমরাও হবো।”

তানহার চোখে জল আসে। কিন্তু তাতে ভয় নেই—এই আলাদা হওয়াটা ত্যাগ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য পথ খুলে দেওয়া।



একদিন গভীর রাতে একটি মেইল আসে।
এক আন্তর্জাতিক NGO, যারা শিকড় প্রজেক্টের মডেল কপি করে নিজের নামে প্রচার করছে।

তাদের মূল উদ্দেশ্য—শিকড় নামটি কিনে নেওয়া এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।

নাদিয়া সেই মেইল দেখে হেসে ফেলে।

“আমার স্বপ্নের নাম কিনে নিতে চায়? স্বপ্ন কি টাকায় বিক্রি হয়?”

নাদিয়া এবার সরাসরি জাতিসংঘ ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার কাছে অভিযোগ করেন।

সাক্ষাৎকারে বলেন—

“আমরা কেবল ক্ষুধা নয়, আত্মার অভাব মেটাতে কাজ করি। ‘শিকড়’ কেবল প্রকল্প নয়—একটি মানুষের সম্মান ফিরে পাওয়ার গল্প।”

বিশ্বব্যাপী মানুষজন এই বক্তব্যে আবেগিত হয়।
#SaveShikor ট্রেন্ড করে।

অবশেষে ঐ NGO নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়।



এই পর্বের শেষ দিকে, নাদিয়া এক চিঠি পায়। পাঠিয়েছেন রায়হান। তাতে লেখা—

“তোমার ছেলেকে নিয়ে আমি গর্ব করি। আমি এখন বুঝি, এক সন্তানের পরিচয় তার রক্ত নয়, তার চেতনায়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই, যদি পারো, আমায় একটা সুযোগ দিও।”

নাদিয়া চিঠিটা পড়ে থাকে। পাশে বসে থাকা আরিজ বলে—

“মা, আমি যদি কখনো বাবাকে চিনতে চাই, তুমি কি বাধা দিবে?”

নাদিয়া বলে না, কেবল মাথা নাড়ে।

সময় যদি সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে, সময়ই চাইলে তা জোড়া লাগাতে পারে।


চলবে…

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৫ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ




 গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১৫
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



নাদিয়া যখন ব্যস্ত শিকড় প্রজেক্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনের প্রস্তুতিতে, ঠিক তখনই একদিন ডাকযোগে একটি বিশেষ আমন্ত্রণপত্র আসে। এটি ছিল ইউনেস্কো থেকে, প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া “Global Roots & Humanity” সম্মেলনের জন্য। সেখানে সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করা ৫টি মানবিক প্রকল্পকে সম্মাননা দেওয়া হবে।

শিকড় প্রজেক্ট তার মধ্যে একটি।

এই সংবাদ শুনে পুরো টিম উৎফুল্ল হয়ে উঠে, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল—এই সম্মেলনের বিচারকদের একজন হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি একসময় শায়লার সাথে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট গ্রুপে কাজ করতেন, এবং শায়লার প্রভাব থাকায় নাদিয়ার প্রজেক্টকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সময়ের আবর্তে সেই ব্যক্তিও এখন মানবিকতার পথে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

নাদিয়া অনুভব করল, সময়ই মানুষের সবচেয়ে বড় বিচারক।



আরিজ তার নতুন অ্যাপ্লিকেশন “RootLink” তৈরি করে ফেলেছে, যেটি দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের মানুষদের শিকড় প্রজেক্টের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে সাহায্য করে। এই অ্যাপে একদিকে যেমন উন্নয়ন প্রকল্পের খবর জানা যায়, তেমনি মানুষ চাইলে নিজ নিজ এলাকার চাহিদাও জানাতে পারে।

ইউনেস্কোর সম্মেলনে আরিজের আবিষ্কার বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিবিদ ও সমাজকর্মীরা তার কাজ দেখে বিস্মিত হয়।

সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নাদিয়া বলে—

“মানবিক উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়। শিকড় প্রজেক্ট একটি পথ মাত্র—যেখানে আমরা সবাই একে অপরের জন্য কাজ করি।”

তার বক্তব্যে হলজুড়ে দাঁড়িয়ে তালি পড়ে।



প্যারিসে থাকাকালীন, এক রাতে হোটেল লবিতে নাদিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় একজন চেনা মুখ—রায়হান

তিন বছর পর।
নিরবতা।
দীর্ঘক্ষণ কেউ কিছু বলেনা।
অবশেষে রায়হান বলল—

“তোমার জয় দেখে গর্ব হচ্ছে, নাদিয়া। অথচ… আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমিই একদিন তোমায় অপমান করে চলে গিয়েছিলাম।”

নাদিয়া চোখ নামিয়ে বলল—

“বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। কেবল একটাই প্রশ্ন রেখেছিলাম বারবার নিজের কাছে—‘আমি কি সত্যিই এতটা অযোগ্য ছিলাম যে, কেউ না শুনেই আমাকে কলঙ্কিনী বলবে?’”

রায়হান মাথা নিচু করে। তার চোখে অনুশোচনা।

“আমি এখন বুঝি… আমরা সমাজের ভাষায় বিচার করতে গিয়ে অনেক সময় ভালোবাসাকেও ভুলে যাই।”

এই মুহূর্তে নাদিয়া জানে, ক্ষমা করা শক্তি। কিন্তু সে কোনো সম্পর্ক ফিরিয়ে নিতে চায় না। সে এবার তার ‘অস্তিত্ব’ নিয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।

ঢাকায় ফেরার পর খবর আসে—শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হয়েছে। তার দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মিডিয়া শায়লার পতনকে শিরোনামে তুলে ধরে।

আর এই সময়েই শিকড় প্রজেক্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথেও চুক্তি করে। যার ফলে উন্নয়নমূলক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

একদিন রাতে সংবাদে শায়লার মুখটা দেখে নাদিয়া চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে করুণা।

তানহা পাশে এসে বলে—

“তুমি যদি তখন তার পথে হাটতে, আজ হয়তো তিনিও তোমার মত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি হারিয়ে গেছেন প্রতিশোধ আর অহংকারে।”

নাদিয়া জানে, প্রতিশোধ নয়—প্রেম, ক্ষমা, আর দায়বদ্ধতাই মানুষকে সত্যিকারের বিজয় এনে দেয়।



শিকড় প্রজেক্ট এবার শিশুদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম চালু করে—“জন্মাধিকার” নামে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে পথশিশু, অনাথ, কিংবা অবহেলিত শিশুদের সুশিক্ষা ও পিতৃত্ব-মাতৃত্বের অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

নাদিয়ার সন্তান, আরিজ, সেই কার্যক্রমের প্রতীক হয়ে ওঠে।

একদিন এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলো—

“তুমি একদিন এই প্রকল্পের জন্য পরিচিত হবে কি মা নাদিয়ার সন্তান হিসেবে? নাকি নিজের কাজের জন্য?”

আরিজ হাসলো—

“আমি গর্বিত যে মা নাদিয়া আমার মা। কিন্তু আমি চাই, আমার কাজ আমাকে আলাদা পরিচয় দিক। যেমন মা চেয়েছিলেন, আমি যেন নিজের পথ নিজে তৈরি করি।”



এই পর্বের শেষ দিকে নাদিয়ার হাতে আসে একটি চিঠি। এটি এসেছে আফ্রিকার একটি ছোট গ্রাম থেকে, যেখানে শিকড় প্রজেক্ট সম্প্রতি একটি স্কুল স্থাপন করেছে।

চিঠির মধ্যে লেখা:

“আমরা জানতাম না পৃথিবীতে কেউ আমাদের কথা ভাবে। আপনি সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আমাদের নাম দিয়েছেন—‘মানুষ’ হিসেবে। আমাদের শিশুদের হাতে বই, মুখে হাসি আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আপনি দিয়েছেন। আপনি আমাদের ‘মা নাদিয়া’।

নাদিয়ার চোখে জল আসে।

এই নামটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়—
মা নাদিয়া।


চলবে...



গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৪ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ






 গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১৪
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



শায়লা রহমানের শেষ চক্রান্তটি ছিল একটি বড় পরিকল্পনা, যেখানে তার মূল লক্ষ্য ছিল নাদিয়ার শিকড় প্রজেক্টকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া। তিনি জানতেন, নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং আর্থিক শক্তির মাধ্যমে সে কিছুটা সফল হলেও, শিকড় প্রজেক্টের প্রতি বিশ্ববাসীর সহানুভূতির জন্য তার প্রতিক্রিয়া কেবল তীব্র হতে পারে। তাই, এবার শায়লা এবং তার গোপন জোটের সদস্যরা পরিকল্পনা করেছিল, নাদিয়া ও তার প্রজেক্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানের একটি কেলেঙ্কারি তৈরি করা হবে।

শায়লা একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে কিছু ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে মনে হয় শিকড় প্রজেক্ট কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। কিন্তু কিছুদিন পর, শায়লা বুঝতে পারে যে তার পরিকল্পনা তেমন কার্যকরী হয়নি। কারণ শিকড় প্রজেক্টের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এটি ছিল একটি ভালো এবং স্বচ্ছ উদ্যোগ, যা স্বীকৃত ছিল পুরো পৃথিবীজুড়ে।

এবার শায়লা চুপচাপ নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে। তবে তাকে দ্রুত বুঝতে হয় যে, তার ষড়যন্ত্র যে একেবারে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাতে তার একান্ত প্রতিপক্ষ—নাদিয়া—অবশ্যই জয়ী হতে চলেছে।



শিকড় প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক মঞ্চে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এটি শুধু একটি উদ্যোগ ছিল না, বরং একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। নাদিয়ার নেতৃত্বে, শিকড় প্রজেক্ট এখন প্রায় প্রতিটি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছিল। নাদিয়া জানত, শায়লা যেকোনো সময় ফের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে, কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল জনগণের কাছে শিকড় প্রজেক্টের ভালো কাজগুলি পৌঁছালে শায়লা সফল হতে পারবে না।

একদিন, নাদিয়া তার দলের সদস্যদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বলল—

“আমরা যদি নিজেদের বিশ্বাস ও সততার ওপর দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে আমাদের শিকড় প্রজেক্ট কখনোই ব্যর্থ হবে না। শায়লা বা যে কোনো বিরোধী দল আমাদের এই পথ থেকে সরাতে পারবে না। আমাদের কাছে একটাই লক্ষ্য—মানুষের কল্যাণ। আর এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।”

তার এই বক্তব্যে দলের সদস্যরা উৎসাহিত হয়ে উঠল। সবাই জানত, তাদের কাজ শুধু সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা নয়, বরং একটি বৃহত্তর মানবিক দায়বদ্ধতা পূরণ করা। তাই তারা নিজের দায়িত্বে ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ চালিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল।



শায়লার ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যাওয়ার পর, তার জীবনে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। তার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক খ্যাতি ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনেকের মতে, শায়লা এখন হারিয়ে গেছে—একটি পদক্ষেপের পর, আর কোনো স্থান তার জন্য নেই।

একদিন, শায়লা তার কার্যালয়ে বসে চুপচাপ চিন্তা করছিল। তার কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ছিল। বারবার তার মস্তিষ্কে ঘুরছিল, “এটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? আমি কি ভুল পথে চলে গেছি?”। এভাবে একসময় তার আত্মবিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

তার একমাত্র ভরসা ছিল তার পুরনো বন্ধু এবং রাজনৈতিক সমর্থকরা, যারা এবার তাকে একাই ফেলে দিয়েছে। শায়লা জানত, তার অতীতের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন আর ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।



যদিও শায়লা নিজের ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়েছিল, তবে নাদিয়া জানত, এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। শিকড় প্রজেক্টের পথ সহজ নয়। একদিকে শায়লার পরাজয়ের পর, বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক জগৎ থেকে নতুন প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কিছু গোপন সংস্থা, যারা শায়লার সমর্থক ছিল, তারা এখন শিকড় প্রজেক্টের বিপক্ষে উঠিয়ে নিয়ে আসছে নানা অভিযোগ।

নাদিয়া তার দলের সদস্যদের সাথে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছিল। একদিন, একটি বৈঠকে সে বলল—

“আমরা যখন এত দূর এসেছি, তখন এই নতুন প্রতিবন্ধকতাগুলো আমাদের পিছিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের দৃষ্টি লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের কাজ এবং উদ্দেশ্যই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।”

তার এই উক্তি দলের সকল সদস্যদের এক নতুন উদ্যমের সাথে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করল। তারা জানত, যেকোনো প্রতিবন্ধকতাকেই তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে।



আরিজ, যে শিকড় প্রজেক্টের প্রতি তার মায়ের মতোই নিবেদিত ছিল, এবার আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। একদিন, সে নাদিয়ার কাছে এসে বলল—

“মা, আমি শিকড় প্রজেক্টের জন্য এক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চাই। আমাদের সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি সংযুক্ত করলে, বিশ্বের সকল শ্রেণির মানুষ সহজেই আমাদের কাজ জানতে পারবে।”

নাদিয়া তার ছেলের কথায় মুগ্ধ হয়ে বলল—

“তুমি যদি সত্যিই এই কাজটি করে দেখাতে পারো, তবে আমাদের কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে। কিন্তু মনে রেখো, এটি শুধু প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়, এটি মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার একটি উপায়।”

আরিজ জানত, তার কাজের মাধ্যমে শিকড় প্রজেক্ট আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। সে তার মায়ের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে, এই উদ্যোগে নিজেকে আরও নিবেদিত করে তুলল।



এভাবে, শিকড় প্রজেক্ট একের পর এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে, যেখানে মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মৌলিক অধিকার পেতে সমস্যায় পড়তে হয়, সেখানে শিকড় প্রজেক্টের কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে।

নাদিয়া একদিন বলল—

“আমরা এখন যে অবস্থানে আছি, সেটি কোনো সহজ পথ ছিল না। প্রতিটি বাধা, প্রতিটি সমস্যা আমাদের শক্তিশালী করে তুলেছে। এবং আমরা প্রতিটি মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছি।”

শিকড় প্রজেক্টের সাফল্য, নাদিয়া এবং তার দলের অবিচল প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক মহলে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যদিও শায়লা এবং তার সমর্থকরা একের পর এক চক্রান্ত করে গিয়েছিল, তবে নাদিয়া তার সততা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সবার কাছে প্রমাণ করে দিয়েছে, সঠিক পথে চললে প্রতিটি বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব।


চলবে.....

গল্প: হতভাগা পর্ব: ১৩ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 




গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১৩
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



শায়লা রহমান, যিনি এক সময় একটি বড় প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, এখন দুনিয়া থেকে একপ্রকার নির্বাসিত। তার রাজনৈতিক ও আর্থিক খ্যাতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু শায়লার কাছে এখনও কিছু শেষ ত্রুটি ছিল—তিনি জানতেন, তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলি তাকে রক্ষা করতে পারে। তার বিরুদ্ধে মামলাও চলছিল, তবে শায়লা নিজের ক্ষমতার শেষ নিঃশেষ করতে চায়নি। এমন একটি সময়ে, সে একটি নতুন ষড়যন্ত্রের ছক কষে।

একটি গোপন মিটিংয়ের মাধ্যমে শায়লা বিভিন্ন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, এবং কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে একত্রিত করে। তার পরিকল্পনা ছিল, নাদিয়া ও তার শিকড় প্রজেক্টের কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী সমর্থক হিসেবে তুলে ধরা। এর মাধ্যমে তার প্রজেক্টের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে এবং নাদিয়াকে তার পথ থেকে সরিয়ে ফেলা যাবে।

"আমরা যদি তার কাজের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে পারি, তাহলে তার প্রজেক্টটি পৃথিবীজুড়ে অচল হয়ে যাবে। আমাদের উপস্থাপন করা তথ্য ও প্রমাণ যদি মিথ্যা না হয়, তবে তাকে ঘিরে সৃষ্টি হবে এক বড় বিপদ," শায়লা সভায় বলছিল।

এবার শায়লা আরও একবার তার শত্রু নাদিয়ার বিরুদ্ধে চক্রান্তে মগ্ন ছিল। তবে সে জানত, এবার আগের মতো সহজ হবে না।



নাদিয়া জানত, শায়লা হারলেও তার ষড়যন্ত্র থামবে না। নাদিয়া নিজেকে প্রস্তুত রাখছিল এমন এক পরিস্থিতির জন্য, যেখানে তাকে শুধু নিজের প্রজেক্ট নয়, পুরো পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে। শায়লার পরিকল্পনার খবর পাওয়ার পর, নাদিয়া এবং তার দল দ্রুত একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করল।

একদিন, নাদিয়া তার দলের সাথে মিটিংয়ে বলল—

“শায়লা আবার কিছু করতে চাইছে। কিন্তু আমরা জানি, তার ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়? আমাদের যদি জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়, তাহলে আমাদের আরও বেশি সতর্ক এবং সংগঠিত হতে হবে। শিকড় প্রজেক্ট শুধুমাত্র একটি প্রজেক্ট নয়, এটি এখন একটি আন্দোলন। আমরা যা করছি, তার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণ। এটি কখনোই কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা সহিংসতার সাথে যুক্ত হতে পারে না।”

নাদিয়া বিশ্বাস করত, সত্যের শক্তি শেষ পর্যন্ত জিতবে। সে জানত, শায়লা যতই চেষ্টা করুক, জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব এবং সঠিক পথের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাসই তাদের জয়ী করবে।



শায়লা যখন তার ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে, তখন তার প্রজেক্টের বিরুদ্ধে মিডিয়া এবং জনমত তৈরি করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। প্রথম দিকে, তার কিছু চক্রান্ত কিছুটা সফলও হয়েছিল। কিছু মিডিয়া রিপোর্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে শিকড় প্রজেক্টের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ উঠতে শুরু করে। তবে শায়লার পরিকল্পনা যেমনই শক্তিশালী হোক, নাদিয়া ও তার দলের কঠোর পরিশ্রম এবং সততার কারণে, খুব দ্রুত এর প্রতিক্রিয়া পাওয়া শুরু হয়।

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম শিকড় প্রজেক্টের সঠিক কাজের প্রমাণ পেয়ে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়—

“শিকড় প্রজেক্টের কাজ বিশ্বের এক অনন্য সামাজিক উদ্যোগ। যাদের উদ্দেশ্য মানুষের উন্নতি, শিক্ষা এবং কল্যাণ, তারা কখনোই সন্ত্রাস বা সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।”

এতে শায়লা আরও একবার হার মানতে বাধ্য হয়। তার যেসব চক্রান্ত এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছিল, সেগুলি জনমনে অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।



নাদিয়া জানত, শায়লা পুরোপুরি হারেনি, তবে তিনি যে জনগণের সমর্থন পেয়েছেন, সেটি ছিল তার বড় শক্তি। শায়লার বিপদ থেকে একধাপ এগিয়ে, নাদিয়া এবং তার দল এক নতুন পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা ঠিক করেছিল, এবার পুরো পৃথিবীতে শিকড় প্রজেক্টের কাজ আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হবে।

নাদিয়া তার পরিকল্পনাটি দলের সদস্যদের জানাল—

“আমাদের কাজ এখন শুধু আমাদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা আরও বড় প্রজেক্ট চালু করবো—বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমাদের লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে এমন একটি উদ্যোগ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি শিশুর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।”

তার এই বক্তব্য শিকড় প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি নতুন দিশা দেখিয়ে দিল। নাদিয়া জানত, এটাই তার প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য। তিনি এই পৃথিবীকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং ন্যায্য সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইতেন।



শায়লা, যিনি কখনোই নিজের আত্মসম্মান হারাতে চায়নি, এবার একেবারে শেষ চক্রান্তের দিকে এগোচ্ছিল। তার পরিকল্পনা ছিল, সে কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করে একটি নতুন গোপন জোট তৈরি করবে। এর মাধ্যমে তিনি নাদিয়ার প্রজেক্টের মূল স্তম্ভের বিরুদ্ধে কাজ করবেন।

তবে, শায়লার শেষ চক্রান্ত ছিল তার নিজের শেষ ধাপ। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ভাবতেন, আবার একবার নাদিয়াকে পরাজিত করতে পারবেন, কিন্তু তার অজানা ছিল, নাদিয়া যে শক্তির সঙ্গে তার দলের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, তা কখনোই পরাজিত হবে না।

এদিকে, আরিজ শিকড় প্রজেক্টের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠছিল। তার মেধা এবং কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে, নাদিয়া তাকে আরও বেশি দায়িত্ব দিয়েছিল। একদিন, আরিজ তার মায়ের কাছে এসে বলল—

“মা, আমি কিছু একটা করতে চাই। শিকড় প্রজেক্টের জন্য আরও ভালো কিছু করতে চাই। আমি জানি, এই মুহূর্তে তুমি অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, কিন্তু আমি তোমার পাশে আছি। তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত।”

নাদিয়া তার ছেলের কথা শুনে চুপচাপ কিছুক্ষণ ভেবেছিল। তারপর সে বলেছিল—

“আরিজ, তুমি যে এতো বড় কিছু করতে চাও, তা দেখে আমি গর্বিত। তবে, মনে রেখো, জীবনটা এক পথ নয়, বহু পথের সমষ্টি। তুমি যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাও, তোমাকে সৎভাবে কাজ করতে হবে, আর মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।”

আরিজের চোখে এক নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। সে জানত, তার মা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তারও সেভাবে এগিয়ে যেতে হবে।


চলবে...
গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১৩
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



গল্প: হতভাগা পর্ব: ১২ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 




গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১২
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



নাদিয়া এবং তার দল যখন শিকড় প্রজেক্টের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে শুরু করে, তখন পুরো পৃথিবী তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে নজর দিতে শুরু করে। নানা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। বিশ্বের উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলির কাছ থেকে নানা ধরনের সহযোগিতা প্রস্তাব আসতে থাকে।

একদিন, নাদিয়া তার দলের সদস্যদের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বসেছিল। তিনি জানতেন, শিকড় প্রজেক্টের জন্য এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তাদের কাজের প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ, অন্যদিকে শায়লা রহমানের ষড়যন্ত্রের স্মৃতি, সব কিছুই তাকে এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

“আমরা শুধু আমাদের দেশেই সফল হতে চাই না,” নাদিয়া বলেছিল, “আমাদের লক্ষ্য হল, বিশ্বব্যাপী সমাজে সমান অধিকার, শিক্ষা এবং উন্নতি নিশ্চিত করা। এই প্রজেক্টকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে হবে, যা শুধু সমাজের এক অংশ নয়, বরং সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবে।”

তার কথায় দৃঢ়তা ছিল, এবং সে জানত যে, এই লড়াইটি তার জীবনকেই শুধু বদলাবে না, পুরো বিশ্বের ভবিষ্যতও পরিবর্তন করতে পারে।



আরিজ, এখন বড় হয়ে উঠছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, সে কিছু একটা করতে চায়—এমন কিছু, যা তার মা নাদিয়ার কাজকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে পারে। সে আজকাল মায়ের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করত। একদিন, মায়ের কাছে এসে সে বলল—

“মা, আমি জানি তুমি সবসময় আমাদের জন্য কাজ করেছো, কিন্তু আমি চাই, আমি তোমার সাহায্যে বিশ্বের জন্য কিছু করতে পারি। আমি শিকড় প্রজেক্টে একজন সক্রিয় সদস্য হতে চাই।”

নাদিয়া তার চোখে প্রশংসার ছাপ নিয়ে তাকিয়ে বলল—

“তুমি জানো, এটা শুধুমাত্র আমাদের দেশের মানুষদের জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য। আর যদি তুমি সত্যিই সাহায্য করতে চাও, তাহলে তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্তে বিশ্বমানের মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। এটা শুধু আমাদের কাজের জন্য নয়, এটা মানবতার জন্য।”

আরিজ জানত, তার সিদ্ধান্ত শুধু তার জীবনে নয়, সমগ্র পৃথিবীকে প্রভাবিত করবে।



যদিও শায়লা রহমান একাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষমতা হারিয়েছে, তবে সে এখনও পর্দার আড়ালে নানা চক্রান্ত করে যাচ্ছিল। তার প্রচেষ্টা ছিল নাদিয়ার শিকড় প্রজেক্টের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিকূলতা সৃষ্টি করা। একদিকে তার অপরাধের বিচার চলছে, অন্যদিকে শায়লা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে নানা গোপন রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে।

একদিন, শায়লা এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল, শিকড় প্রজেক্টের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো এবং সেই সঙ্গে নাদিয়ার প্রজেক্টের উৎসগুলিতে বাধা সৃষ্টি করা। কিন্তু এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের মাঝেও, শায়লা জানত, সে খুব দ্রুতই সামনে আসবে এবং তার গোপন কৌশলগুলো প্রকাশ পাবে। তবে, সে নিশ্চিত ছিল যে, যতই সে অন্ধকারে কাজ করুক না কেন, তার আগ্রাসী পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত নাদিয়ার কাছেই ফিরবে।



শিকড় প্রজেক্টের কাজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর, নাদিয়া একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়। সেখানে বিশ্বের উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

নাদিয়া সম্মেলনে যোগ দেয় এবং সেখানে তার বক্তব্য রাখে—

“শিকড় প্রজেক্ট শুধু একটি উদ্যোগ নয়, এটি পৃথিবীজুড়ে এমন এক আন্দোলন যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজে থেকেই নিজেকে উন্নত করতে পারবে। এটি একটি সামাজিক সমাধান যা সকলকে সমান অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সমাজের উন্নতি নিশ্চিত করবে।”

তার বক্তব্য শোনার পর, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার ওপর প্রশংসার ঝড় তোলে। বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন সংস্থাগুলি শিকড় প্রজেক্টের সাথে একযোগে কাজ করতে আগ্রহী হয় এবং নতুন অর্থায়ন প্রস্তাব গ্রহণ করতে শুরু করে।



শায়লা, যিনি আশা করেছিলেন নাদিয়ার প্রজেক্টটি দমন করা যাবে, এখন বুঝতে পারে যে, নাদিয়া এবং তার দল সত্যিই বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। শায়লার অসফলতার সাথে সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্কও হুমকির মুখে পড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থায়নও কমতে শুরু করে।

অন্তর্দ্বন্দ্বে থাকা শায়লা একদিন একটি গোপন মিটিংয়ে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়—

“যতদূর সম্ভব, আমাকে নাদিয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু এবার আমাকে কিছু নতুন চিন্তা করতে হবে। হয়তো আমি শুধু তার বিরুদ্ধে কাজ করলে হবে না, তার প্রজেক্টের অভ্যন্তরীণ কাজেও ভাঙন ধরাতে হবে।”

শায়লা জানত, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নাদিয়ার জন্য আরও বড় এক বিপদ নিয়ে আসবে। তবে শায়লার জানা ছিল না যে, নাদিয়া যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো শক্তি অর্জন করেছে।



এরই মধ্যে, নাদিয়া নিজের প্রজেক্টের নতুন দিক পরিকল্পনা করে চলছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, শায়লার চক্রান্ত কোনো বাধা হতে পারে না যদি শিকড় প্রজেক্টের অভ্যন্তরীণ শক্তি সঠিক থাকে।

একদিন, নাদিয়া একটি নতুন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা শুরু করে—

“আমরা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও বেশি কার্যক্রম চালু করবো। বিশেষ করে সেই সকল এলাকার প্রতি যেখানে সুযোগের অভাব রয়েছে। আমাদের উদ্যোগ যেন শুধু বড় শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ না থাকে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।”

এটি ছিল শিকড় প্রজেক্টের নতুন ধাপ, যেখানে শুধু বড় শহর নয়, পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পৌঁছানোর পরিকল্পনা ছিল।




গল্প: হতভাগা পর্ব: ১১ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ




 গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১১
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ


 

এক সপ্তাহের মধ্যেই শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত তদন্ত সম্পন্ন হয়ে যায়। সংবাদপত্রে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় একে একে প্রকাশ হতে থাকে তার অপকর্মের প্রমাণ। শায়লা নিজের ভুল স্বীকার করতে না চাইলেও, তথ্যপ্রমাণে ফাঁস হয়ে যায় তার মিথ্যাচার।

নাদিয়া তার দলের সদস্যদের সাথে মিটিংয়ে বসে। সে জানত, শায়লার পতন শুধু তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নয়, বরং দেশের মানুষের জন্য এক বড় জয়। এবার তারা পুরো পৃথিবীকে দেখাতে পারবে যে, শিকড় প্রকল্প সত্যিকারের উন্নতি ও সচেতনতায় কাজ করছে।

"এটা আমাদের বিজয় নয়, এটা আমাদের সেই সমস্ত মানুষের বিজয় যারা প্রতিনিয়ত তাদের অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য লড়াই করছেন," নাদিয়া বলেছিল, তার মুখে দৃঢ়তার ছাপ।

এদিকে, শায়লা যখন পিছু হটে, তখন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একে একে তার সমস্ত অপরাধের বিচার শুরু হয়, এবং সে জানত, তার ক্ষমতার দিন শেষ।



নাদিয়া জানত, এই লড়াইয়ের শেষে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবে, তবে তার মনে এক অদৃশ্য ক্ষত রয়ে গেছে। শায়লার মতো মানুষের প্রতারণা সহজেই ভোলা যায় না। প্রজেক্টের কাজেও কিছু সময়ের জন্য অবাঞ্ছিত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।

রাতের অন্ধকারে একদিন, নাদিয়া একা বসে ছিল। তার চোখে অশ্রু ছিল না, কিন্তু তার মন কিছুটা ভারী হয়ে উঠেছিল। এতদিন সে শুধু প্রকল্পের জন্য কাজ করেছে, কিন্তু আজ তাকে ভাবতে হয়েছিল তার নিজের জীবন, নিজের সন্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে। সবার চোখে তাকে যে অপরাধী হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনুভূতি তার জন্য একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে একটি নতুন দ্বন্দ্ব।

"এই মুহূর্তে আমি জানি না, আগামীকাল আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে," নাদিয়া মনে মনে ভাবছিল। "কিন্তু আমি জানি, আমি যেখানেই যাব, সঠিক পথেই যাব।"



একদিন, আরিজ তার মায়ের কাছে গিয়ে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিল—

“মা, তুমি তো সবকিছু জানো, আমাদের জীবন এত লড়াইয়ের পরও কেন আমি অন্যদের মতো সাধারণ হতে পারলাম না? কেন আমার জীবনটা এত কঠিন?”

নাদিয়া স্তম্ভিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আরিজের দিকে তাকিয়ে বলল—

"আরিজ, জীবন কখনো সহজ ছিল না। আর সহজ কিছু হঠাৎ আসে না। তুমি যেটা দেখেছো, সেটা শুধুমাত্র পরিশ্রম, বিশ্বাস, এবং সঠিক পথের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। তুমি যদি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে চাও, তুমি যদি অন্যদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চাও, তোমাকে কখনোই হাল ছাড়তে হবে না।"

আরিজ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে যেন এক নতুন আশা তৈরি হয়েছিল। সে জানত, তার মা নাদিয়া তাকে সঠিক পথ দেখাবে।



শায়লা রহমান যখন তার দুর্দশা বুঝতে পারে, তখন তার মধ্যে এক অদ্ভুত ভয় কাজ করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং তার অপকর্মের প্রকাশিত তথ্য তাকে একেবারে কোণঠাসা করে দেয়। একদিকে আদালতের চাপ, অন্যদিকে সমাজের তীব্র নিন্দা, শায়লা বুঝতে পারে যে তার সব কিছু এখন শেষ।

কিন্তু সে হাল ছাড়ে না। শায়লা জানত, তার শেষ সুযোগ হল, সে যদি নাদিয়ার সম্মান নিয়ে কিছু গড়তে পারে, তবেই তার কিছুটা প্রতিশোধ পাওয়া যাবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কেমন হবে? শায়লা কি নাদিয়াকে শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে পারবে? নাকি সব কিছু হারিয়ে ফেলে তাকে আরেকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে?



এদিকে, নাদিয়া ও তার প্রজেক্টের দল শিকড় প্রজেক্টের বিষয়ে আরো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে শুরু করেছিল। এরই মধ্যে তাদের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বব্যাপী সমর্থনও বেড়েছিল। নাদিয়া মিটিংয়ে একদিন বলেছিল—

"আমরা শুধু একটি সমাজ পরিবর্তন করতে চাই না, আমরা চাই পৃথিবীজুড়ে সমাজে একটা শক্তিশালী নৈতিক পরিবর্তন আসুক।"

অন্যদিকে, শায়লার অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের জাল আরও জটিল হয়ে যাচ্ছিল। তবে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একেবারে ভিন্ন। সে আসলে চেষ্টা করছিল সব কিছু নতুনভাবে গুছিয়ে নেওয়ার।



নাদিয়ার মনোভাব সেদিন থেকে একেবারে পরিবর্তিত হয়। শায়লার বিরুদ্ধে মামলা চালানো, সমস্ত ঘরবাড়ি পরিবর্তন করা, এইসব তাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে থাকে। শায়লা যখন তীব্র আঘাত দেয়, তখন নাদিয়া নিজের শক্তি অনুভব করে। নিজের পেশাদারিত্ব এবং নৈতিক অবস্থা ধরে রেখে, সে বুঝতে পারে, আসল শক্তি হচ্ছে বিশ্বাস।

এটা ছিল তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত—যেখানে সে নিজের সঠিক পথের দিকে এগিয়ে চলে, এবং এর মাধ্যমে পৃথিবীকে দেখিয়ে দেয় যে, এক টুকরো আশা দিয়েও মানুষের জীবন পরিবর্তন করা সম্ভব।



এই মুহূর্তে নাদিয়া বুঝতে পারে, তার স্বপ্ন কেবল তার নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যাদের জীবন সংকটমুক্ত এবং সমান অধিকারী হতে পারে, তাদের। শিকড় প্রজেক্টের পরবর্তী ধাপ ছিল একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক উদ্যোগের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

নাদিয়া জানত, এই লড়াইয়ের পরবর্তী পর্যায় আরও কঠিন হবে, তবে সে কখনো হাল ছাড়বে না। একদিন তার প্রজেক্ট পুরো পৃথিবীকে পরিবর্তন করবে। সে দৃঢ়ভাবে জানত, তার সন্তান আরিজ এবং তার প্রজেক্ট একদিন সমাজে একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে।

চলবে......



গল্প: হতভাগা পর্ব: ১০ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ






 গল্প: হতভাগা

পর্ব: ১০
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



ঢাকা শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শায়লা রহমান তার মুঠোফোনের স্ক্রীনে কয়েকটি ফাইল স্ক্যান করে। মুখে ক্ষণিকের হাসি, কিন্তু সেই হাসি এক ধরনের ক্ষোভ আর প্রতিশোধের। তিনি জানতেন, নাদিয়ার উত্থান তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, কিন্তু কিছু অর্জনের জন্য কিছু হারাতে হয়।

শায়লা ফোনে বললেন—

“আপনারা কি প্রস্তুত? ‘শিকড়’ প্রজেক্টের বিরুদ্ধে আমি যে অভিযোগ তুলেছি, তা বাস্তবায়িত হলে নাদিয়া শেষ হয়ে যাবে।”

তিনি তাঁর সাহায্যকারীকে নির্দেশ দিলেন, “এখনই মিডিয়াতে এই খবরটি ফাঁস করো। নাদিয়াকে একদম কোণঠাসা করতে হবে। এই পৃথিবীতে কেউ সহজে উঠে আসে না। তাকে যদি নষ্ট করতে চাই, তবে তার অতীতকে কাজে লাগাতে হবে।”



কনফারেন্স শেষে ঢাকা ফিরে এসে, নাদিয়া সেদিন রাতেই ফোনে শায়লার অভিযোগের বিষয়ে জানতে পারে। মিডিয়াতে একটি শিরোনাম ভাসতে থাকে—

“শিকড় প্রজেক্টের পেছনে অবৈধ অনুদান, নাদিয়া এক মাফিয়াদের অংশ?”

এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাদিয়ার জীবনে এক নতুন ঝড় আসে। সংবাদপত্রে, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, তার নামে উঠতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। শুধু কটূক্তি নয়, তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাবও তৈরি হতে থাকে। তার দলের কিছু সদস্যও সন্দেহ করতে শুরু করেন, অনেকেই তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করতে থাকেন—

“আপনি কী জানতেন এসব?”

নাদিয়া জানত, শায়লার এই চক্রান্ত শুধু তার নয়, শিকড় প্রজেক্টের প্রতিটি সদস্যের ওপর আঘাত। কিন্তু সে কখনো হাল ছাড়বে না। এবার তার বিরুদ্ধে একটা বড় লড়াই অপেক্ষা করছে।



সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি লাইভ সেশন শুরু করে নাদিয়া। তার চোখে দৃঢ়তা, কথায় নির্ভীকতা ছিল।

“আজ যে প্রশ্নগুলো ওঠানো হচ্ছে, আমি জানি আপনারা অনেকেই সেই প্রশ্নের উত্তর চান। আমি শুধু আপনাদের বলব, আমার ও আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ যদি সত্য হয়, আমি নিজে নিজের বিরুদ্ধে মামলা করবো। কিন্তু যতটুকু জানি, ‘শিকড়’ প্রজেক্ট একটিই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে—এ পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করা।”

নাদিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন থামায়। তিনি জানতেন, এখন শুধু তার নিজস্ব সততা, কঠোর পরিশ্রম ও প্রমাণের ওপর ভরসা রাখতে হবে।



রায়হান ফিরে এসে নাদিয়াকে আশ্বস্ত করে। দুই জনেই জানতেন, শায়লার চক্রান্ত থামানোর একমাত্র উপায় হল সঠিক প্রমাণ বের করা। রায়হান ফোনে তার আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বলে—

“আমরা শায়লার সব কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখব। যারা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ চাই। সময় লাগবে, কিন্তু আমরাও হাল ছাড়ব না।”

এমন কঠিন সময়ে রায়হান নাদিয়ার পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে তার প্রতি এক অদৃশ্য বন্ধন আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে।



“শিকড়” প্রজেক্টের সদস্যরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে শুরু করে, তবে এখন তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে এক নতুন তীব্রতা। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি উদ্যোগ যেন আরও বেশি দৃষ্টির মধ্যে ছিল। স্কুলে নতুন শিশুদের ভর্তি, অঙ্গীকারের ভাষা—সবকিছুই প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও চালু রাখছিল নাদিয়া।

একদিন, প্রজেক্টের এক কর্মী—ফারহান—নাদিয়াকে জানায়, “ম্যাডাম, শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রমাণ পেয়েছি। আপনি কি চান আমরা এগুলোর ওপর কাজ করি?”

নাদিয়া মাথা নিচু করে, কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল—

“হ্যাঁ, আমরা শয়তানের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে পারব। তবে আমাদের পথ সঠিক থাকতে হবে।”

এটি ছিল তার প্রথম সত্যিকার প্রতিশোধের মুহূর্ত, কিন্তু নাদিয়া জানত, এখনই তাকে সকল প্রমাণ পাবার চেষ্টা করতে হবে, যাতে পরিস্থিতি তার বিপক্ষে না চলে যায়।



এদিকে, আরিজ তার জীবনের এক বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। স্কুলের বন্ধুরা এবং সমাজের নানা পক্ষ থেকে, তার মা নাদিয়ার বিরুদ্ধে কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু আরিজ জানত, মা কখনো কোনো অন্যায় করেননি।

সে একদিন মায়ের কাছে এসে বলল—

“মা, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি সত্যি জানো, আমি জানি তুমি আমাদের জন্য সব করতে।”
“তবে, আমি আর তোমার সাথে থাকব, আজ থেকেই তোমার প্রজেক্টের বিষয়ে আরও বেশ কিছু দায়িত্ব নিতে চাই।”

আরিজের কথাগুলো নাদিয়াকে স্তম্ভিত করে দেয়। সে জানত, তার সন্তান আরও বড় হয়ে উঠছে। আরিজের সাহসিকতা তার পরিবারকে নতুন আশার আলো দেখায়।



এবার নাদিয়া এবং তার দলকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। দেশি এবং আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে তারা শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে শুরু করে।

রায়হান বলল—

“এটা শুধু ‘শিকড়’ প্রজেক্টের লড়াই নয়, এটা সারা বাংলাদেশের সেই সব মানুষের লড়াই, যারা নিজেদের অধিকার চেয়ে প্রতিনিয়ত সমাজের রুখে দাঁড়িয়ে থাকে।”



শায়লা রহমানের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়ে গেলে, সেই তথ্য সাংবাদিকদের সামনে পেশ করা হয়। মিডিয়ায় শ্বেতসন্ধ্যার আলোয় আসতে থাকে শায়লার সব অন্ধকার দিক।

নাদিয়া জানত, এই লড়াইয়ের জয়ী হতে হলে একে একে প্রতিটি ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু সে আশাবাদী ছিল যে একদিন তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।


চলবে...
গল্প: হতভাগা
পর্ব: ১০
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



গল্প: হতভাগা পর্ব: ৯ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৯
শিকড়ের ডালপালা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ


১. এক নতুন ভোর

ঢাকার গুলশান এক্সিকিউটিভ কনফারেন্স হলে আজ ভিড় জমেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, মিডিয়া, এবং এনজিও নেতাদের। মঞ্চে উঠছেন এক নারী—তার গায়ে সাদা সালোয়ার-কামিজ, মুখে দৃঢ়তা, চোখে আত্মবিশ্বাস।

নাদিয়া।

তিনিই “হতভাগা”র প্রতিষ্ঠাতা এবং “শিকড়” প্রজেক্টের মুখ।

তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন:

“আজ আমি এখানে এসেছি একজন মা হিসেবে, একজন কলঙ্কিনী হিসেবে নয়। আমি জানি কীভাবে সমাজ আমাদের মতো মানুষদের তিরস্কার করে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, শিকড় যত গভীর, গাছ তত দৃঢ় হয়।”

ঘরে তখন করতালির ঝড়।


২. ‘শিকড়’ প্রজেক্ট কী?

‘শিকড়’ প্রজেক্ট মূলত পথশিশু, অবৈধ জন্মপ্রাপ্ত শিশু, গুম হওয়া পিতামাতার সন্তান, এবং সমাজবঞ্চিত শিশুরা যাতে আত্মপরিচয় পায়, শিক্ষা পায়, আইনি সহায়তা পায়—সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এখানে নাদিয়ার সন্তান আরিজ এই প্রজেক্টের মুখপাত্র হিসেবে শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলে জাতিসংঘের সেমিনারে।

সে বলে—

“আমরা বাবা-মায়ের পরিচয়ে না, আমাদের স্বপ্নের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।”

সারা হল দাঁড়িয়ে পড়ে।


৩. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

জাতিসংঘের শিশু অধিকার ফোরাম (UNCRC) “শিকড়” প্রজেক্টকে South Asian Model Initiative হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘Human Dignity Award’ এর জন্য “হতভাগা” মনোনীত হয়।

ফ্রান্সের বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী Élise Fournier বলেন—

“বাংলাদেশে নাদিয়া যা করেছেন, তা একাই এক বিপ্লব। আমরা তাঁর পাশে আছি।”

এমন সময়ই গল্পে আসে এক নতুন মোড়।


৪. নতুন প্রতিপক্ষ

একটি প্রভাবশালী স্থানীয় NGO—“নতুন দিগন্ত”, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি অনুদানে চলে আসছে, হঠাৎ নাদিয়ার উত্থানে ক্ষুব্ধ হয়।

তাদের পরিচালক শায়লা রহমান বলেন এক গোপন মিটিংয়ে—

“একটা মেয়ের অতীত যতই কলঙ্কে ভরা হোক, মিডিয়া তাকে মহান বানিয়ে ফেলছে। ওর প্রতিষ্ঠানের পেছনে যদি আমরা দুর্নীতির প্রমাণ পাই, তবে সব শেষ হয়ে যাবে।”

তারা তদন্ত শুরু করে, আর কিছু ঘুষখোর মিডিয়া ব্যবহার করে ‘হতভাগা’র কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলে।


৫. আরেক মুখোমুখি যুদ্ধ

নাদিয়া দেখেন, আন্তর্জাতিক পুরস্কারের আগেই তার বিরুদ্ধে “স্বেচ্ছাচারিতা, অনুদানের অপব্যবহার, এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের” মামলা দায়ের হয়।

রায়হান বলেন—

“এটা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তুমি তাদের জায়গা কাড়ছো, এখন তারা তোমার জায়গা নিতে চায়। কিন্তু তুমি হাল ছেড়ো না।”

নাদিয়া নির্ভয়ে মুখোমুখি হন আদালতের।

তার হয়ে আইনি সহায়তা দেয় এক ব্রিটিশ আইনজীবী David Moore, যিনি আগেই “শিকড়” প্রজেক্টে স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন।


৬. সামাজিক প্রতিবাদের ঢেউ

সোশ্যাল মিডিয়ায় #আমার_শিকড় ট্রেন্ড হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাবা-মায়ের পরিচয়হীনতা, অবজ্ঞা, অথবা সমাজের কাছে অবমাননার গল্প শেয়ার করতে থাকে।

নাদিয়া বলেন:

“আমি কারও শত্রু না, আমি শুধু চেয়েছিলাম সন্তানদের সম্মান নিয়ে বড় করতে। যদি তাই অপরাধ হয়, আমি সেটাও মেনে নেব।”


৭. মুখোমুখি নাদিয়া ও শায়লা

একটি বিতর্কিত টকশোতে দুই সংগঠক—নাদিয়া ও শায়লা মুখোমুখি হন।

শায়লা বলেন—

“আপনি একজন অপরাধীর সন্তানকে সামনে রেখে আবেগের ব্যবসা করছেন।”

নাদিয়া জবাব দেন—

“আপনি হয়তো সিল্ক শাড়ি পরে সমাজসেবা করেন। আমি কলঙ্ক বুকে নিয়ে মানুষ গড়ি।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ সেই রাতেই ৫০ লাখ মানুষ দেখে। জনসমর্থন যায় নাদিয়ার দিকে।


৮. পুরস্কারের রাত

“হিউম্যান ডিগনিটি অ্যাওয়ার্ড” গ্রহণের জন্য জেনেভায় এক অভিজাত অনুষ্ঠানে নাদিয়া ও আরিজ উপস্থিত।

নাদিয়া বলেন—

“আমার পরিচয় আমি ‘হতভাগা’। কিন্তু এই পরিচয়েই আমি গর্বিত, কারণ তা শুধু আমার না, সমাজের হাজারো ‘অপরিচিত’ মুখের। আজ আমরা কথা বলছি, কাল তারা নিজের পরিচয়ে দাঁড়াবে।”


৯. শেষ দৃশ্য: শিকড় ছড়িয়ে পড়ছে

ঢাকায় ফিরে এসে নাদিয়া দেখেন, দেশের ১৪টি জেলায় ‘শিকড়’ প্রজেক্টের শাখা চালু হয়েছে।

একজন স্বেচ্ছাসেবী এসে বলে—

“আপার নাম শুনে তো গ্রাম থেকে এক বাচ্চা মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে, বলে—আমি ‘হতভাগা’র স্কুলে পড়তে চাই।”

নাদিয়া চেয়ে থাকেন দূরের দিকে। তার চোখে জল।

রায়হান পাশে এসে দাঁড়ায়, বলে—

“তোমার অতীত তোমার ওজন ছিল। আজ সেটা তোমার ডানায় পরিণত হয়েছে।”


চলবে…


গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৯
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



গল্প: হতভাগা পর্ব: ৮ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৮
শিকড়ের দিকে ফিরে দেখা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



“মা, আমি তো বলেছিলাম না, আমাকে তোমার মতো হতে হবে না। আমি আমার মতো হয়ে উঠবো।”
— এই কথা বলে ১০ বছর বয়সী আরিজ দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

নাদিয়া চুপচাপ বসে থাকে। সামনে জন্মদিনের কেক, পাশে রায়হান, আর চারপাশে ‘হতভাগা’র মেয়ে ও ছেলে সদস্যরা—কিন্তু যেন উৎসবের মাঝে ছায়া নেমে আসে।

আজ আরিজের জন্মদিন। দশ বছর পার হয়েছে। একটি শিশুর বেড়ে ওঠা, তার হাজারো প্রশ্ন, সমাজের কটুকথা, বাবার অনুপস্থিতি—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে সে আজ স্কুলের সেরা ছাত্রদের একজন।

কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আরিজের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন।

সে একা থাকে, বই পড়ে, কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ঘুম ভেঙে যায়।

রায়হান বলে—
— “ওর ভিতরে কিছু চাপা পড়ে আছে। সময় এসেছে, ওর সাথে সত্যি কথা বলার।”

নাদিয়া আরিজের রুমে ঢোকে। দেয়ালে আঁকা ছবি—একটা পাহাড়, যার নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু, আর সামনে একটি অন্ধকার গুহা।

নাদিয়া জিজ্ঞেস করে—
— “তুমি কি ভয় পাচ্ছো আরিজ?”

আরিজ চুপ থাকে।

— “তোমার কী জানতে ইচ্ছে করে, তোমার বাবা কে? কেন কেউ আসেনা তোমার জন্মদিনে?”

আরিজ ধীরে ধীরে ঘাড় তোলে—
— “মা, আমার স্কুলে আজ কেউ বলেছে, ‘তোর তো বাবা নেই, তোর মা তো… তুমি জানো না, তুমি কার সন্তান।’ আমি জানতে চাই। তুমি আমাকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছো।”

নাদিয়ার মুখ শুকিয়ে যায়।

সে বলে—
— “তুমি আমার প্রাণ, আমার অন্ধকার সময়ের আলো। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার জন্ম সহজ ছিল না। তোমার জন্ম আমার লাঞ্ছনার সাক্ষী, কিন্তু ভালোবাসারও।”

আরিজ বলে—
— “আমি জানি না আমি কার সন্তান, মা। কিন্তু আমি জানতে চাই—সে কোথায়? সে কে?”



নাদিয়া কাঁপা হাতে একটা ধূলিধূসর বাক্স বের করে। সেখানে রাখা পুরোনো ডায়েরি, হাসপাতালের রিপোর্ট, মামলার কাগজপত্র—আর একটি অজানা চিঠি।

চিঠিতে লেখা:
“নাদিয়া,
তুমি যেটা করছো, সেটা সমাজের চোখে অপরাধ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তুমি এক যোদ্ধা। আমি যদি কখনও আরিজকে দেখে যেতে না পারি, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমি জানি, তুমি তাকে মানুষ করবে, ঠিক আমার মতো নয়—তোমার মতো।”


(এক সময়ের বাড়ির ড্রাইভার, যার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল নাদিয়া… যার বিরুদ্ধে কেউ কখনও মামলা করেনি, কারণ সে অদৃশ্য হয়েছিল)।

রায়হান তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে—
— “তুমি আমাকে কখনো বলেনি, সে এক ধর্ষণ ছিল, নাকি সম্মতি ছিল?”

নাদিয়া বলে—
— “আমি নিজেও বুঝিনি। একাকীত্ব, শূন্যতা, অবহেলা—এসবের ভেতর দিয়ে একজন মানুষ কখন কতটা ভেঙে পড়ে, তা বোঝা যায় না। কিন্তু হ্যাঁ, আমি কোনোদিন বাধ্য হইনি, আবার সজ্ঞানেও ছিলাম না। তাই আমি তাকে কখনো দোষ দিইনি।”



পরদিন আরিজ এসে জানায়—
— “আমি বাবাকে খুঁজে বের করবো, মা। যদি সে বেঁচে থাকে, আমি তার মুখোমুখি হতে চাই।”

নাদিয়া বাধা দেয় না।

রায়হান সহায়তা করে। তারা খোঁজ নিতে শুরু করে—নাম, ঠিকানা, পুরনো বন্ধুদের স্মৃতি, গুমের তালিকা।

অবশেষে এক সন্ধ্যায় একটি NGO থেকে খবর আসে—“আমরা একজন মানুষের সন্ধান পেয়েছি, যিনি ১০ বছর আগে একটি আশ্রমে ছিলেন মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায়। তার নাম পাওয়া যায়নি, কিন্তু তিনি বারবার বলে যান, ‘আমার ছেলেকে আমি খুঁজে পাবো...’”



নদীর পাশে একটি পরিত্যক্ত শ্মশান ঘরে ছোট্ট কুঁড়ে তৈরি। সেখানে বসে আছে একজন বৃদ্ধ, মুখে দাড়ি, গায়ে ময়লা চাদর।

আরিজ তাকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

সে সামনে গিয়ে বলে—
— “তুমি কি আমাকে চেনো?”

বৃদ্ধ তাকিয়ে দেখে, তারপর ফুঁপিয়ে ওঠে।

— “তুই... তুই আলো! আমি তোর জন্যই বেঁচে ছিলাম। তুই আমার ভুলের ফল না, তুই আমার বাঁচার কারণ।”

নাদিয়া এসে দাঁড়ায়, কাঁদে।

সানজিদ বলে—
— “আমি কোনোদিন ক্ষমা পাবো না। আমি তো তোর মা'কে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু নিজের সীমা ভুলেছিলাম। তারপর সমাজ, ঘৃণা, ভয় আমাকে পাগল করে দিয়েছিল।”

আরিজ বলে—
— “তুমি যদি ভুল করে থাকো, তবে আমার জন্ম কি শুধুই দুঃখ?”

নাদিয়া বলে—
— “না, তুমি আমার জীবন। সে যাই হোক, তুমি মানুষ, আর তুমি জানার অধিকার রাখো কে তোমার শিকড়।”



ফিরে আসার পথে একদল সাংবাদিক রেকর্ড করে সবকিছু।
খবরের শিরোনাম হয়:
"হতভাগার প্রতিষ্ঠাতা একজন ধর্ষকের সন্তানের মা?"
"শিশুকে সত্য বলার শিক্ষা, নাকি অপরাধীর সাথে পুনর্মিলন?"

সরকারি অনুদান স্থগিত। সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। নাদিয়াকে হয়রানি শুরু হয়।

UNHCR আর্থিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দেয়।

রায়হান বলে—
— “তুমি কি চাইছো আমি তোমাদের থেকে সরে যাই?”

নাদিয়া বলে—
— “না। আমি আরিজকে সত্য শিখিয়েছি, কিন্তু সমাজের মুখে তালা দিতে পারিনি। এখন যদি আমরা চুপ থাকি, তবে ওর সাহসও মরে যাবে।”


নাদিয়া সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।

তিনি বলেন—
— “আমি একটি শিশু জন্ম দিয়েছিলাম, ঘৃণার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসা দিয়েছি। আমি চাইনি আমার সন্তান প্রতিশোধে বড় হোক, চাইনি সে ঘৃণা করতে শিখুক। আজ যদি সমাজ আমার মুখ দেখে বলে আমি অপরাধী, তবে বলি—হ্যাঁ, আমি অপরাধ করেছি—একটি সন্তানকে বাঁচিয়ে তোলা, তাকে সত্য শেখানো।”

তারপর আরিজ মাইক হাতে নেয়—
— “আমি যদি অপরাধের ফল হই, তবে আমি সেই অপরাধকেই পরিবর্তন করে মানবতার মুখ করবো।”

হল স্তব্ধ।



UNHCR পুনরায় বিবৃতি দেয়—“আমরা সহানুভূতিশীল পরিবার ও মানসিক পুনর্গঠনের এই মডেলকে সমর্থন করি।”

‘হতভাগা’ আরও বড় উদ্যোগ নেয়—শিশুদের জন্য ‘শিকড়’ প্রজেক্ট, যেখানে অবৈধ, অস্বীকৃত, গুম হওয়া বা পরিচয়হীন বাবা-মায়ের সন্তানদের পরিচয়-প্রাপ্তির এবং মানসিক শক্তি গঠনের কাজ হবে।

নাদিয়া আর আরিজ হাতে হাত রেখে হাঁটে—
সানজিদ দূর থেকে হাসে, এবং অন্ধকারের মধ্য থেকে ছায়া সরে যায়।


চলবে…
গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৮
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



পর্ব: ৭ গল্প: হতভাগা লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৭
নতুন পথ, পুরোনো ছায়া
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



সকালবেলা ‘হতভাগা স্কিল একাডেমি’র মূল ফটকে এক অচেনা গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নামল সুসজ্জিত এক যুবক—গা শিরশিরে ঠান্ডা চোখ, পরিপাটি পোশাক, হাতে দামি ঘড়ি, কাঁধে ব্যাগ।

তিনি সোজা রিসিপশনে এসে বলেন—
— “আমি আরমান হোসেন। UNHCR-এর পক্ষ থেকে এসেছি। আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও সহায়তা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।”

রায়হান এবং নাদিয়া বিস্মিত। এতদিনে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ দেখাল?
আরমানকে বসানো হয় সভাকক্ষে। কাগজপত্র, প্রজেক্ট রিপোর্ট, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব উপস্থাপন করা হয়।

আরমান মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখে বলেন—
— “আমি সত্যিই অভিভূত। বাংলাদেশে এমন মানবিক কাজ খুব কম দেখা যায়। UNHCR একাধিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে—বিশেষত নারী পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়ন নিয়ে। ‘হতভাগা’ আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।”

নাদিয়া মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানায়।

তবে রায়হানের মনে একটা কাঁটা যেন খচখচ করে। যুবকের চোখে যেন কিছু লুকানো কুয়াশা।



চায়ের ফাঁকে আরমান বলেন—
— “আপনারা জানেন, একজন অসহায় নারী যখন নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তখন সে শুধু নিজেকে না, একটা প্রজন্মকে বাঁচায়। UNHCR চায়, আপনাদের এই উদ্যোগকে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে তৈরি করতে।”

নাদিয়ার চোখ জ্বলে ওঠে—
— “এমন স্বীকৃতি যদি পাই, তবে সমাজের চোখ খুলবে। আমাদের আর বলতে হবে না—আমরা ‘হতভাগা’ নই, আমরা ভাগ্য নির্মাতা।”

আলোচনা শেষে আরমান নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন—
— “আপনার গল্প আমি জানি। আপনি আমার জন্য এক অনুপ্রেরণা। কিন্তু আমি এসেছি শুধু দায়িত্ববোধ থেকে না, আরও কিছু আছে…”

নাদিয়া চমকে ওঠে।

আরমান নিচু স্বরে বলে—
— “আমি আপনাকে আগে থেকেই চিনতাম। আমি ছিলাম আপনার প্রাক্তন কলেজমেট—তখন আমি ছিলাম অনামিকা নামে পরিচিত। হ্যাঁ, আমি ট্রান্সজেন্ডার।”

ঘরে নিস্তব্ধতা।

রায়হান চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে।

নাদিয়া ধীরে ধীরে বলে—
— “তুমি… তুমি সেই অনামিকা? যে নাকি চুপচাপ থাকতো, কারো সাথে মিশতো না, আর সবাই তাকে কটাক্ষ করতো?”

আরমান মাথা নাড়ে—
— “হ্যাঁ। তুমি একমাত্র যে আমাকে ‘লুকিয়ে থাকা ফুল’ বলেছিলে। সেই সাহসী কথাটাই আমাকে গড়েছে।”



সন্ধ্যা। অফিসঘর ফাঁকা। নাদিয়া একা বসে। দরজা খুলে আরমান আসেন।
নাদিয়া বলেন—
— “তোমার পরিবর্তন দেখে অভিভূত হয়েছি। তুমি তো এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে... মনে আছে সেই ছাদে দাঁড়ানো সন্ধ্যাটা?”

আরমান হেসে ফেলে—
— “তোমার ফোনটাই আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলো। তুমি বলেছিলে, ‘যদি সবাই তোমাকে না বোঝে, তার মানে তুমি আলাদা নও, ওরা অন্ধ।’ সেই কথাটা আমার পৃথিবী বদলে দেয়।”

নাদিয়ার চোখে জল। এতগুলো বছর পর পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে যেন একটুকরো চাঁদ খুঁজে পেল সে।

আরমান বলেন—
— “এখন আমি চাই, তোমার মতো সাহসী নারীদের পাশে দাঁড়াই। তোমার প্রতিষ্ঠানে ট্রান্স নারী বা পুরুষদের জন্য আলাদা ট্রেনিং সেল খোলার পরিকল্পনা আছে আমার।”

নাদিয়া বলে—
— “তোমাকে আমি একদিন একবারই বলেছিলাম, ‘তুমি সুন্দর’। আজ আমি সত্যিই গর্বিত—তুমি নিজেই এখন এক অনন্য সৌন্দর্য।”



আরমানের প্রস্তাবে ‘হতভাগা’ একাডেমিতে শুরু হয় ‘রূপান্তরিত মানুষদের জন্য বিশেষ কোর্স’। নাম হয়—"রংধনু শাখা"

তিনজন ট্রান্স নারী এসে ভর্তি হন—
১. শেফালী: যিনি নাচ জানেন, কিন্তু নাচের মাধ্যমে সম্মান পাননি কখনো।
২. মিন্টু: ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কিন্তু লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে চাকরি পায়নি।
৩. রোকসানা: যাকে পরিবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

তাদের নিয়ে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। সমাজের চোখে প্রশ্ন, কটূক্তি, ট্রল—সবকিছুকে জয় করার যুদ্ধ।

কিন্তু নতুন ঝড় আসে সেই রাত্রিতে।



রাত্রি দুইটা। অফিসের পেছনের দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
সিসি টিভিতে দেখা যায়, মুখোশধারী চারজন ভেতরে ঢুকে কাগজপত্র তছনছ করেছে। ট্রান্স অংশগ্রহণকারীদের ডেটা এবং রেজিস্টার চুরি গেছে।

পুলিশ আসে। রায়হান বলেন—
— “এটা সাধারণ চুরি না। তারা আমাদের থামাতে চায়—আমাদের ‘বিপ্লব’কে থামাতে চায়।”

নাদিয়া চিন্তায় পড়ে যায়।
আরমান বলেন—
— “আমি বুঝতে পারছি কে এর পেছনে। দক্ষিণাঞ্চলে একদল ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী আছে, যারা নারী ও রূপান্তরিত মানুষদের ক্ষমতায়নকে বিরোধিতা করে।”

রায়হান চিন্তিত—
— “তবে কি আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে?”

আরমান বলেন—
— “আমরা UN-এর সহায়তায় ডিজিটাল সিকিউরিটি ও নিরাপদ নথি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আনব।”



এর মাঝে পায়েল তার সন্তানের জন্ম দেয়। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো কাঁদে না কেউ—সবাই খুশিতে হাসে।
পায়েল তার সন্তানের নাম রাখে—আলো

নাদিয়া তাকে বলে—
— “এই আলো হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। সে জানবে, পাপ তাকে তৈরি করেনি—ভালোবাসাই করেছে।”

সেই সময় শেফালী একটি থিয়েটার গোষ্ঠী তৈরি করে, যেখানে সমাজে বঞ্চিত ট্রান্স ও নারী সদস্যরা মঞ্চনাটক করে। প্রথম নাটকের নাম—“হতভাগা কাহিনী”



আরমানের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা দেখে আবার মুখ তোলে রুবিনা।
সে এবার একটি মিডিয়ায় কাজ করছে এবং একটি “এক্সপোজে” তৈরি করে—যেখানে দেখানো হয়, ‘হতভাগা’ কেন্দ্র নাকি LGBTQ+ প্রচারকেন্দ্র।
ভিডিও ভাইরাল হয়। দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়।

বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এর প্রতিবাদ করে।

রায়হান বলেন—
— “তারা আবার সেই পুরোনো অস্ত্র ব্যবহার করছে—ঘৃণা, অপবাদ, ভয়ের রাজনীতি।”

নাদিয়া বলেন—
— “আমরা কি থামবো?”

আরমান বলেন—
— “না। এই যুদ্ধটা আমাদের পরিচয়ের, মর্যাদার, এবং ভবিষ্যতের। এ যুদ্ধ ভালোবাসার।”



‘হতভাগা’ এবার পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে। সেখানে রায়হান স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
— “আমরা কারো ধর্মের বিরুদ্ধে না, আমরা শুধু মানুষের পাশে।
আমরা নারী, পুরুষ, ট্রান্স—সবাই মানুষ হিসেবে থাকতে চাই।
আমাদের অপরাধ শুধু একটাই—আমরা বাঁচতে চাই।”

আরমান বলেন—
— “যারা ভয় দেখায়, তারা জানে না—ভালোবাসা ভয়কে জিতিয়ে দেয়।”

মিন্টু দাঁড়িয়ে বলে—
— “আমি আর কাঁদবো না। আমি মিন্টু—একজন মানুষ। যন্ত্র ঠিক করতেও পারি, হৃদয়ও।”

থিয়েটার দল তাদের প্রথম নাটক নিয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে ডাক পায়। এবং ‘হতভাগা’ আন্তর্জাতিক NGO সম্মেলনে পুরস্কার পায় “Inclusive Model of Empowerment” হিসেবে।


চলবে…


পর্ব: ৭
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



গল্প: হতভাগা পর্ব: ৬ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৬
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



রাত দশটা। 'হতভাগা' আশ্রয়কেন্দ্রের অফিসঘরে বসে নাদিয়া আগের দিনের কাগজপত্র মিলিয়ে দেখছে। হঠাৎ করেই বাইরে এক নারীর কান্নার শব্দ ভেসে এলো। নাদিয়া দেরি না করে ছুটে গেল মূল ফটকের দিকে।

সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে—বয়স সতেরো কি আঠারো। গায়ে রক্ত, চোখ ভয়ে ভরা। কোলে একটা ছোট্ট পুঁটলি। নাদিয়া তার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলো।

— "তুমি নাম বলো মা, ভয় পেও না। আমরা তোমার পাশে আছি।"

মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে—
— "আমি পায়েল... বিয়ের নাম করে এক লোক আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। পরে বিক্রি করে দেয় এক দালালের হাতে। আমি পালিয়ে এসেছি। পেটের এই বাচ্চাটা সেই পাপের ফল।"

নাদিয়া নিঃশ্বাস টেনে বলে—
— "এই ঘরটা কোনো পাপ দেখে না, শুধু দেখে সাহস। তুমি এখন থেকে নিরাপদ।"

কিন্তু পায়েলের আগমনের পর থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রকে নিয়ে বাইরের সমাজে আবার প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া পোস্ট, নিউজপোর্টালে শিরোনাম—
“হতভাগা: নারী আশ্রয়ের আড়ালে কি অন্য ব্যবসা?”


এমতাবস্থায় একদিন প্রশাসনের একটি দল আসে তদন্তে। থানার এক পুলিশ অফিসার, সমাজসেবা অধিদপ্তরের দুজন কর্মী এবং সাংবাদিকের দলসহ এক বিশাল তদারকি।

তদন্ত শুরু হয় পায়েলকে ঘিরে। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে,
— “তুমি কি নিশ্চিত এই আশ্রয়কেন্দ্র নিরাপদ?”

পায়েল মাথা নিচু করে বলে,
— “আপনারা যদি ওনাদের এখানে না আনতেন, আমি হয়তো আজ কাঁদতেই পারতাম না। আমার কান্নারও জায়গা নেই ছিলো। এখানে আমি আছি, শুধু তা-ই না—বাঁচছি।”

রায়হান সোজা দাঁড়িয়ে বলে—
— “আপনারা প্রশ্ন করেন আমাদের বিরুদ্ধে? দোষ আমাদের না, সমাজের, যে পায়েলের মতো মেয়েদের ভয় দেখায়, আর সাহসীদের সন্দেহ করে।”

এক সাংবাদিক তীব্র প্রশ্ন ছোড়ে,
— “আপনার স্ত্রী নাদিয়া নিজেও তো একটি বিতর্কিত চরিত্র। একজন ‘অবৈধ’ সন্তানসম্ভবা নারী হিসেবে সমাজ আপনাকে ক্ষমা করেনি। আপনি কীভাবে তাকে সংগঠনের মুখ বানালেন?”

নাদিয়া তখন ধীর কণ্ঠে বলে—
— “যে সমাজ অবৈধ শব্দ দিয়ে একজন নারীর চরিত্র বিচার করে, তারা কি কখনো পুরুষের চরিত্র প্রশ্ন করে? আমার সন্তান অবৈধ না—অবহেলিত সমাজে জন্ম নিয়েছে, তবু সে সম্মানের দাবিদার।”

এমন সাহসী জবাবে পুরো ঘরে স্তব্ধতা। একজন মহিলা সমাজকর্মী ধীরে ধীরে হাততালি দেয়। তারপর সবার মুখে সেই তালি ছড়িয়ে পড়ে।



এরই মাঝে রুবিনা—সেই পুরোনো প্রতিবেশী, যে একসময় নাদিয়াকে নোংরা অপবাদ দিয়েছিলো, হঠাৎ এসে ক্ষমা চায়।

— “ভাবি, আমি একটা ভুল করেছিলাম। আমার বলা কথায় তোমার জীবনে অনেক বিপদ হয়েছিলো। এখন বুঝি, তুমি যা করেছো, অনেক মেয়ে তা করতে পারে না।”

নাদিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।

কিন্তু পরে দেখা যায়, রুবিনা এখন একটি নতুন NGO-র হয়ে কাজ করছে, যারা 'হতভাগা' কেন্দ্র বন্ধ করার জন্য তৎপর। তার ক্ষমা ছিল এক নাটক, একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অংশ।

একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় নাদিয়া দেখতে পায়—আশ্রয়কেন্দ্রের দেয়ালে স্প্রে করে লেখা:
“নাদিয়া = চরিত্রহীন। হতভাগা = পাপের কারখানা।”

রায়হান ফুঁসে ওঠে।
— “এদের থামাতে হবে। আইনিভাবে, সামাজিকভাবে।”

নাদিয়া মাথা ঠান্ডা রেখে বলে—
— “তারা আমাদের টানতে চায় আবর্জনার মধ্যে। আমরা বরং আলো জ্বালাই, যাতে ওদের অন্ধকার আরও স্পষ্ট হয়।”



রায়হান সিদ্ধান্ত নেয়—রুবিনার বিরুদ্ধে কোর্টে মানহানির মামলা করবে। প্রমাণ আছে—ভিডিও, কলরেকর্ড, ফেসবুক পোস্ট।

কিন্তু ঠিক সেই সময় নাদিয়া রায়হানকে থামে—

— “তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও, নাকি ন্যায় বিচার চাও?”

রায়হান জবাব দেয়—
— “আমি চাই, যারা আমাদের বন্ধ করতে চায়, তারা বুঝুক—সত্যি কখনো থামে না।”

নাদিয়া তখন বলে—
— “তাহলে প্রতিশোধ নয়, পথ দেখাও। আমরা মিডিয়াতে একটা ওপেন প্রেস কনফারেন্স করি। সমস্ত মেয়ে যারা এখান থেকে নতুন জীবন পেয়েছে, তাদের সামনে আনো। সত্যিটা ওরাই বলবে।”

এবং হয় ঠিক তাই। দিন নির্ধারিত হয়—“হতভাগা সত্য সম্মেলন”



একটি অডিটোরিয়ামে বড় করে ব্যানার টানানো হয়েছে—
“আমরা কলঙ্ক নই—আমরা বেঁচে থাকার গল্প”

প্রথম বক্তা সীমা—
— “আমার স্বামী আমার চোখের সামনে আমার মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেদিন আমি মরতাম। কিন্তু নাদিয়া আপা আমাকে বলেছিলো, ‘তুমি মরলে ওরা জিতবে’। আজ আমি একটি নার্সিং ট্রেনিং কোর্স শেষ করেছি।”

পরের বক্তা পায়েল—
— “আমি শুধু নিজের সন্তানের জন্যই না, সেই মেয়েদের জন্যও বাঁচতে চাই যারা আজও কাঁদে। ভাবি আমাকে নাম দিয়েছেন ‘আলো পায়েল’। আমি এখন আঁধারকে ভয় পাই না।”

মঞ্চে ওঠে নাদিয়া। তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, শুধু দৃঢ়তা—
— “আজ যারা আমাদের প্রশ্ন করছে, তাদের জবাব দিয়েছে এই মেয়েগুলো। যারা একদিন সত্যিই ‘হতভাগা’ ছিল, আজ তারা সমাজের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ—কারণ তারা বেঁচে আছে, মাথা উঁচু করে।”



তদন্তের পর আদালতের নির্দেশে রুবিনার NGO-র কার্যক্রম স্থগিত হয় এবং তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা চলে। সব প্রমাণ দেখে রায়হান শেষমেশ মামলা তুলে নেয়।

নাদিয়া বলে—
— “আমরা দেখালাম, ক্ষমা করা মানেই দুর্বলতা নয়। সেটাই আমাদের শক্তি।”

ঠিক তখনি ফোন আসে—শাহিনুর বেগম মারা গেছেন।

নিরবতা ছায়ার মতো ঘর জুড়ে বসে পড়ে। রায়হান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ে।

— “আমি তো ভাবতাম, একদিন ওনার কোলেই মাথা রাখব… আর সে দিনটা আসার আগেই সব শেষ।”

নাদিয়া তার হাত ধরে বলে—
— “তুমি তার সন্তান। যত ক্ষোভই থাক, মা কখনো শেষ হয় না। আর তুমি তো তার জন্যই লড়ছিলে… সেটা জানলে তিনি শান্তি পাবেন।”



মায়ের কবর থেকে ফিরে রায়হান আর নাদিয়া সিদ্ধান্ত নেয়—'হতভাগা' এখন শুধু আশ্রয়কেন্দ্র নয়, এটি হবে একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট

নতুন প্রজেক্টের নাম হয়—“হতভাগা স্কিল একাডেমি”
যেখানে নারী ও শিশুদের জন্য থাকবে কম্পিউটার ট্রেনিং, হস্তশিল্প, সেলাই, নার্সিংসহ আরও নানা কোর্স।

উদ্বোধনের দিন রায়হান বলে—
— “আমরা হয়তো সমাজকে বদলাতে পারি না পুরোপুরি। কিন্তু অন্তত কিছু জীবন বদলে দিতে পারি। আর সেটাই আমাদের সার্থকতা।”


চলবে…
পর্ব: ৬
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ


📗প্রিয় পাঠক পাঠিকরা হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf📄 নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।



💝প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুরোধ!


আপনি যখন আমার গল্পটি পড়ছেন, তখন শুধু একটি গল্পই নয়—আমার স্বপ্নকেও সমর্থন করছেন। গল্পের শেষে থাকা **মাত্র ৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি** ক্লিক করলে আমার সামান্য আয় হয়। ফেসবুক বা ওয়েবসাইট সরাসরি আয় দেয় না, কিন্তু **আপনার একটি ক্লিক** আমাকে নিয়মিত গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করে!  


এই ছোট্ট সহযোগিতাটুকুই আমার জন্য বিশাল। আপনার ভালোবাসা আর সমর্থন পেলে আমি আরও মন দিয়ে গল্প লিখতে পারব। ❤️  


**🔗 বিজ্ঞাপন লিঙ্ক:** 👇

https//wwwaddsadstaraadda.com


**#আপনার_এক_ক্লিক_আমার_অনুপ্রেরণা**  



✨ **ধন্যবাদ** আমার গল্পের পাশে থাকার জন্য!  





৪থ পর্ব লিংক👇

 https//mgugoloplikestorehotobagapartth




হতভাগা পর্ব ৫: লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



হতভাগা

পর্ব ৫: অজানা পথের যাত্রী

লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নদিয়ার। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। পাশেই ছোট্ট বালিশে ঘুমিয়ে আছে ওর ছেলেটা, নাম রেখেছে নিলয়। সাত মাস বয়স, চোখে-মুখে বাবার ছায়া, অথচ সেই বাবাই কোথায় আজ, নদিয়া জানে না। নিলয়ের মুখের দিকে তাকালে নদিয়ার মনে হয়, এই ছোট্ট মুখটাই যেন তার অস্তিত্ব। সে যেন আর নিজেকে নিয়ে ভাবে না, ভাবে শুধু নিলয়কে নিয়ে।

নদিয়া এখন একটি মেসে থাকে—রামপুরার গলির মধ্যে, পাঁচজন মেয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটা ছোট ঘর। ঘর বলতে চারদিকে ইটের দেয়াল, একটা জানালা, আর একটা বাথরুম। ঘর ভাড়া দেয় এক অবিবাহিত মহিলা, নাম পারভীন, বয়স পঁচিশ ছুঁই ছুঁই। ও-ও একসময়ে পরিবার ছেড়ে এসেছিল, স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার, কিন্তু সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশে গেছে।

নদিয়া চাকরি নেয়েছে একটা বুটিক হাউজে—বাগিচা ফ্যাশন নামে এক দোকান। মিরপুর রোডে অবস্থিত, ওখানে সে কাপড় ভাঁজ করে, কখনও কাস্টমার সামলায়, আবার কখনও ঝাড়ু দেয়। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ, বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায়ই চলে ওর ও নিলয়ের খরচ। মাঝে মাঝে পারভীন বা পাশের মেয়েরা সাহায্য করে। তবে নদিয়া কারও কাছে হাত পাততে চায় না, চেয়েও না।

সন্ধ্যা নামলে নদিয়া এক কোণে বসে কাপড় সেলাই করে। ওর মা ছোটবেলায় তাকে সুই-সুতো ধরতে শিখিয়েছিল। সেই হাতের কাজই এখন ওর সবচেয়ে বড় ভরসা। কয়েকটা নিয়মিত কাস্টমার পেয়েছে সে—কারও ব্লাউজ ফিটিং, কারও সালোয়ারের পাড় লাগানো, তো কারও আবার নতুন কুর্তি বানানো। এই বাড়তি ইনকামে মাসের শেষে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

একদিন দোকানে হঠাৎ এক নতুন ক্রেতা আসে—মাঝবয়সী, সুপরিচিত চেহারা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনার নাম নদিয়া না?” নদিয়ার বুক ধক করে ওঠে। “আপনি কে?” সে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।

লোকটা হেসে বলে, “আমি রায়হান। একটা এনজিও-তে কাজ করি, শহরের আশ্রয়হীন মা ও শিশুদের নিয়ে।”

নদিয়া কেমন যেন বিব্রত হয়। “আপনি কীভাবে চিনলেন আমাকে?”

“আমার সহকর্মী একদিন এই দোকান থেকে কিছু কিনেছিল, তোমার কথাও বলেছিল। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম—তুমি কেমন আছো।"

রায়হান বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলে, তারপর একদিন মেস পর্যন্ত আসে। পারভীনের সঙ্গে কথা বলে, তারপর নিলয়ের সঙ্গেও খেলে। নদিয়া বিস্মিত হয় এই মানুষটার আন্তরিকতায়।

তারপর একদিন রায়হান প্রস্তাব দেয়, “তুমি চাইলে আমাদের এনজিও-তে শিশুদের জন্য একটি ডে-কেয়ার সুবিধা পাবে। তুমি সকালবেলা নিলয়কে দিয়ে এসে কাজ করতে পারো। ওখানে ওর খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো সব ব্যবস্থাই থাকবে।”

নদিয়ার চোখে জল আসে। এতদিন নিলয়কে ঘরে রেখে কাজে যাওয়া, মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে মেসের মেয়েরা দেখত, কিন্তু মন তো পড়ে থাকত ছেলেটার দিকেই। এখন যদি একটু নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে!

নদিয়া রাজি হয়। পরদিনই রায়হান তাকে নিয়ে যায় সেগুনবাগিচায় ‘আলোকধারা’ নামের সেই এনজিও-তে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, দায়িত্বশীল কর্মী, খেলার সামগ্রী—সব দেখে নদিয়ার মন ভরে যায়।

সেই থেকেই নদিয়ার জীবনে ধীরে ধীরে বদল আসে। সে নিয়মিত কাজ করে, সন্ধ্যায় ফিরে নিলয়কে নিয়ে গল্প করে, ছুটি পেলে মাঠে নিয়ে যায়। নিলয়ও ওর হাসি দিয়ে পৃথিবীটা বদলে দিতে পারে যেন।

কিন্তু সমাজ কি থেমে থাকে?

একদিন মিরপুর রোডের দোকানে এক পুরোনো পরিচিত এসে দাঁড়ায়—নদিয়ার খালাতো ভাই। “তুই এখানে?” তার গলায় বিষ। “মায়ের মুখ ডুবিয়েছিস, বাচ্চা নিয়ে দোকানে কাজ করিস? নাম না করলি ভালো, শোন!”

নদিয়া একটুও থামে না। সে মাথা উঁচু করে বলে, “আমার কাজের গরিমা আছে। আমি চুরি করি না, ভিক্ষা করি না। বাচ্চা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি।”

লোকটা আর কিছু না বলে চলে যায়। কিন্তু তার কথা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে নদিয়ার মনে।

রায়হান একদিন নদিয়ার হাতে একটি কাগজ দেয়। “আমরা কিছু মায়েদের নিয়ে একটা আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করছি। তুমি চাইলে তোমার জীবনের গল্পটা লিখে দাও। অনেকে তোমার মতো সাহস খুঁজে পাবে।”

নদিয়া ভয় পায়। নিজের দুঃখের কাহিনি কে জানবে? কে পড়ে দেখবে? কিন্তু আবার ভাবে—যদি একজন নারীও পড়ে অনুপ্রাণিত হয়, তাহলেই বা ক্ষতি কী?

সে লিখতে শুরু করে। প্রতিরাতে কিছু করে লিখে, এক মাস পরে দেয় রায়হানের হাতে। রায়হান পড়ে শেষ করে বলে, “তুমি জানো না, তোমার ভেতরে কী শক্তি আছে নদিয়া।”

বইটি প্রকাশিত হয়—“হতভাগা থেকে যোদ্ধা” নামে।

সাংবাদিকেরা খোঁজ নেয়, সাক্ষাৎকার নেয়। নদিয়ার নাম উঠে আসে কাগজে, ম্যাগাজিনে।
একদিন এক টিভি চ্যানেল থেকে ফোন আসে—“আপনাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।”

নদিয়া চমকে যায়। সে কি পারবে? সে কি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারবে?

রায়হান তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি তো প্রতিদিন সাহস দেখাও, এইটুকু তো তুচ্ছ।”

নদিয়া যায়। অনুষ্ঠান হয়। দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়। সেই হাততালির শব্দে হারিয়ে যায় আগের সব অপমান, লজ্জা, দুঃখ।

তবে, সুখ কখনও চিরস্থায়ী হয় না।

এক সন্ধ্যায়, যখন নদিয়া নিলয়কে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল, একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জানালার কাঁচ নেমে যায়।

সেখানে এক পরিচিত মুখ—নিলয়ের বাবা!

চোখে চশমা, মুখে একটু বয়সের ছাপ, কিন্তু নদিয়ার মনে পড়ে সেই রাতের কথা, সেই প্রতিশ্রুতি, সেই ফেলে যাওয়া ভোর।

লোকটি শুধু একটুকু বলে, “নদিয়া, আমাকে একটু সময় দাও... আমি সব কিছু বোঝাতে চাই।”

নদিয়া নিশ্চুপ। কোলে ঘুমন্ত নিলয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। পুরোনো ক্ষত যেন হঠাৎ আবার ফেটে গেল।


(চলবে...)

💝হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।

⭕শত্য প্রযোজ্য।


💝প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুরোধ!


আপনি যখন আমার গল্পটি পড়ছেন, তখন শুধু একটি গল্পই নয়—আমার স্বপ্নকেও সমর্থন করছেন। গল্পের শেষে থাকা **মাত্র ৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটি** ক্লিক করলে আমার সামান্য আয় হয়। ফেসবুক বা ওয়েবসাইট সরাসরি আয় দেয় না, কিন্তু **আপনার একটি ক্লিক** আমাকে নিয়মিত গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করে!  


এই ছোট্ট সহযোগিতাটুকুই আমার জন্য বিশাল। আপনার ভালোবাসা আর সমর্থন পেলে আমি আরও মন দিয়ে গল্প লিখতে পারব। ❤️  


**🔗 বিজ্ঞাপন লিঙ্ক:** 👇

https//wwwaddsadstaraadda.com


**#আপনার_এক_ক্লিক_আমার_অনুপ্রেরণা**  



✨ **ধন্যবাদ** আমার গল্পের পাশে থাকার জন্য!  





৪থ পর্ব লিংক👇

 https//mgugoloplikestorehotobagapartth




পর্ব: ৫ গল্প: হতভাগা লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 



গল্প: হতভাগা
পর্ব: ৫
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

রায়হান আর নাদিয়ার জীবনে এক নতুন সকাল। 'হতভাগা' নামের যে সংগঠনের স্বপ্ন তারা বুনেছিল, তা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। শহরের উপকণ্ঠে একটি পুরনো বাড়ি সংস্কার করে চালু হচ্ছে সেই আশ্রয়কেন্দ্র—সেই আশ্রয়, যেখানে মেয়েরা নির্যাতনের ইতিহাস নয়, নিজের ভবিষ্যৎ গড়বে।

নাম—“হতভাগা আশ্রয়ণ কেন্দ্র”



সকাল ৯টা। ঘরের প্রতিটি কোণে ব্যস্ততা। রায়হান অফিস থেকে কিছু কর্মী নিয়ে এসেছে, যারা অফিসিয়াল ফাইল তৈরির কাজ করছে। নাদিয়া প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখছে—শিশুদের ঘর, কাউন্সেলিং রুম, রান্নাঘর সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না।

একটা ছোট ঘরে তিনটি খাট বসানো হয়েছে। বালিশের পাশে রাখা কিছু বই। দেয়ালে লেখা—


এই লাইনটা নাদিয়া নিজেই লিখেছে।

তখনই একজন নারী আসেন দরজায়। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মুখে চাপা কান্নার ছাপ। কোলে ছোট্ট এক মেয়ে।

— “আপারা, আমার নাম সীমা। আমি পালিয়ে এসেছি আমার স্বামীর হাত থেকে। আমাকে কি একটু থাকতে দেবেন এখানে?”

নাদিয়া হাসিমুখে বলে,
— “আপনার বাড়ি এখন এইখানেই। আর কখনো আপনাকে পালাতে হবে না।”

সীমা চোখ মুছে বলে,
— “আপার গল্পটা পত্রিকায় পড়েছিলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম, যদি কোনোদিন বাঁচতে চাই, তাহলে আপনাদের কাছেই আসব।”

নাদিয়া ওর হাত ধরে বলে,
— “আপনার বাঁচা আজই শুরু হলো।”



এই সময়ে একদিন হঠাৎ খবর আসে—শাহিনুর বেগম গুরুতর অসুস্থ। স্ট্রোক হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি।

রায়হান খবর শুনে স্থির হয়ে যায়।

তিন বছর হয়ে গেল—মা আর ছেলে কথা বলেনি। নাদিয়ার প্রসঙ্গে যে কঠিন কথা বলা হয়েছিল, সেটা এখনো রায়হানের বুকে শেকড় গেড়ে আছে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক কি চাইলেই মুছে ফেলা যায়?

নাদিয়া বলে,
— “তোমার উচিত, মায়ের পাশে যাওয়া।”

রায়হান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে,
— “সে মা আমার স্ত্রীকে কলঙ্কিনী বলেছিল।”
— “হয়তো এখন তার বুকেও তীব্র অনুশোচনা আছে। এখন সময় সম্পর্ক জোড়ার, ছিঁড়বার নয়।”

রায়হান চুপচাপ চলে যায় হাসপাতালে। কেবিনে ঢুকে দেখে, বৃদ্ধা মা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। চোখের কোণ ভেজা। ডাক্তার বলে দিয়েছেন—চাপ খুব কম, যেকোনো সময় খারাপ কিছু হতে পারে।

রায়হান ধীরে ধীরে মায়ের পাশে বসে। হাতটা ধরে।
— “মা, আমি এসেছি।”

শাহিনুর বেগম চোখ মেলে তাকায়। কান্না জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বলেন,
— “বাবা, আমি ভুল করেছি। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। তোদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তোর বউকে কখনো ভুলতে পারিনি... প্রতিদিন আল্লাহর কাছে মাফ চাই।”
— “মা, আল্লাহ চাইলে সব মাফ হয়। তুমি শুধু বাঁচো। আমরা আবার একসাথে থাকব।”

এই প্রথম বার রায়হান নিজের চোখে পানি দেখে। সেই মা, যে কঠোর ছিলেন, আজ এক গুচ্ছ অনুশোচনায় নরম হয়ে গেছেন।



‘হতভাগা আশ্রয়ণ কেন্দ্র’ দিনে দিনে একটি আলোচিত প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কাভার করে। এনজিও, সরকারি প্রতিষ্ঠানও সাহায্যের হাত বাড়ায়।

কিন্তু, নতুন আলো যতই জ্বলে, পুরনো অন্ধকার ততই ছায়া ফেলে।

একদিন খবর আসে—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক মিথ্যে গল্প ছড়ানো হচ্ছে। কেউ বলছে, “নাদিয়া নিজের খ্যাতি আর টাকা কামানোর জন্য এসব করছে।”
কেউ বলছে, “ওর চরিত্র এখনো সন্দেহজনক, ওর বাচ্চার আসল বাপ কে তা আজও কেউ জানে না।”

নাদিয়া সব শুনেও চুপ থাকে। কিন্তু সীমা এসে একদিন বলে,
— “আপা, আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে সহ্য হয় না।”

নাদিয়া বলে,
— “তাদের কথা শোনার দরকার নেই। তারা কোনোদিন আমাদের জায়গায় ছিল না, থাকবে না।”

রায়হান পাশে এসে বলে,
— “জানো, তুমি যত ওপরে উঠছো, ততই নিচু লোকদের আওয়াজ বাড়বে।”

নাদিয়া মাথা নিচু করে বলে,
— “আমার শুধু ভয় হয়, আমার ছেলে একদিন এই কথাগুলো শুনে কি ভাববে?”

রায়হান ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
— “সে গর্ব করবে, মা হিসেবে একজন যোদ্ধা পেয়েছে বলে।”



‘হতভাগা’ সংগঠন একদিন আয়োজন করে একটি বড় অনুষ্ঠান—“সাহসিনী উৎসব”। যেসব নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের সম্মাননা দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা নাদিয়া। স্টেজে উঠে চুপ করে দাঁড়ায়। পুরো মিলনায়তন স্তব্ধ। কেউ কেউ মোবাইল দিয়ে ভিডিও করে, কেউ চোখ মুছে।

নাদিয়া বলে—

“আমি একদিন গর্ভবতী হয়েছিলাম, যখন সমাজ বলেছিল, এই সন্তান পাপের ফল।
আমি ঘরে ফিরিনি, রাস্তায় ফিরিনি—আমি নিজের অস্তিত্বে ফিরেছি।

আমার সন্তান আজ স্কুলে যায়। হাসে, দৌড়ায়। তাকে দেখে কেউ বলে না, সে ‘পাপের ফল’।
কারণ সে আমার মতো একটি মেয়েকে নতুন জীবন দিয়েছে।

আমি চাই, এই পৃথিবীতে আর কোনো মেয়েকে ‘হতভাগা’ না শুনতে হয়।
তাকে বলা হোক—‘তুমি একা নও।’”

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তালি দেয়। সেদিন ‘হতভাগা’ নামটা আর একটি অপবাদ নয়, সেটি এক উৎসাহের প্রতীক



ঠিক যখন সব কিছু গুছিয়ে আসছিল, একদিন সীমা চিৎকার করে ছোটে—
— “আপা! তানিয়ার খবর পেয়েছি। ওকে ওর স্বামী খুন করে ফেলেছে!”

তানিয়া ছিল ‘হতভাগা’ কেন্দ্রে প্রথম দিককার বাসিন্দা। সে নিজের সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। পরে নিজেই গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, সমাজের চাপে।

নাদিয়া খবর শুনে বসে পড়েন মাটিতে।

— “আমি ওকে রক্ষা করতে পারিনি… আমি ব্যর্থ...”

রায়হান পাশে বসে বলে,
— “তুমি একা নও। আমাদের লড়াইটা এখনো অনেক বাকি। আমাদের আর একটা তানিয়াকে হারাতে দেওয়া চলবে না।”



একদিন সকালে, রায়হান নাদিয়াকে বলে,
— “তোমার জীবনের গল্পটা একটা সিনেমা বানাতে চাই এক পরিচালক। রাজি হবে?”

নাদিয়া চুপ করে। বলে,
— “গল্পটা আমার না। এটা হাজার হাজার মেয়ের। যদি ওদের কণ্ঠ হয়, তাহলে হ্যাঁ।”

ফেব্রুয়ারি মাসে ‘হতভাগা’ নামে সিনেমা মুক্তি পায়। প্রচুর দর্শক দেখে, ভালোবাসে।

নাদিয়ার ছেলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে বলে,
— “মা, সবাই বলে তুমি হিরো... তুমি কি হিরো?”

নাদিয়া হেসে বলে,
— “আমি মা, আর তুই আমার হিরো।”

ছেলেটা বলে,
— “তাহলে আমি একদিন তোমার মতো হবো।”



হতভাগা নামের মেয়েটি এখন শতভাগ সাহসের প্রতীক। তার গল্পের শুরু যেখানে “পাপ” বলে ডাকা হয়েছিল, সেইখান থেকেই সে প্রমাণ করেছে—“পাপ নয়, সে প্রত্যাঘাত।”


চলবে…
পর্ব: ৫
গল্প: হতভাগা
লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ



গল্প: হতভাগা পর্ব: ৪ লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

 





 

গল্প: হতভাগা

পর্ব: ৪

লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ


ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেছে। আদালতের রায় ঘোষণার পর কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। তিনজন অপরাধী এখন কারাগারে। সমাজের চোখে নাদিয়া এখন এক ‘বীর নারী’। কিন্তু নিজের মনে? প্রতিদিন সকালেই প্রশ্ন করে সে নিজেকে—"আমি কি আসলেই ঠিক আছি?"


ছোট্ট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে বারান্দায় বসে। কোকিলের ডাক শোনে। হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচল দুলে ওঠে। একটুকরো শান্তি, কিন্তু অস্থির এক হৃদয়ের মাঝে।


রায়হান সেই সকালে অফিস গেছে। এখন সে একটি এনজিওতে কাজ করে, যেখানে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ হয়। নাদিয়া নিজেও মাঝে মাঝে অংশ নেয় তাদের প্রজেক্টে।


ঠিক তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। অপরিচিত নম্বর।


— “হ্যালো, আপনি কি নাদিয়া আক্তার বলছেন?”

— “জি, আমি নাদিয়া।”

— “আমি সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম, দৈনিক যুগধ্বনি থেকে বলছি। আমরা আপনার জীবনের গল্পটা নিয়ে একটি কভার স্টোরি করতে চাই। আপনি কি রাজি হবেন?”


নাদিয়ার চোখ স্থির হয়ে আসে। সে চায় না তার সন্তান আর তার নাম একসাথে খবরে উঠুক। কিন্তু আবার ভাবে—"যদি আমার গল্প আরও একজন মেয়েকে সাহস দেয়?"


— “আমি সময় নিয়ে আপনাকে জানাবো, ভাই। একটু ভাবতে দিন।”

— “অবশ্যই, আপা। আমরা অপেক্ষা করব।”


ফোনটা রেখে ছেলের কপালে একটা চুমু খায় নাদিয়া।

— “তুইই আমার শক্তি, বাবু।”


---


একদিন বিকেলে রায়হান বাড়ি ফিরে দেখে নাদিয়া অদ্ভুত চুপচাপ।

— “কি হয়েছে তোমার?”

— “তুমি কি চাও সবাই জানুক আমি কীভাবে মা হয়েছি?”

— “আমার চাইতে বড় কথা হলো, তুমি কী চাও?”


নাদিয়া জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,

— “আমি চাই, আমার কষ্ট কারও উপহাস না হোক। কিন্তু যদি আমার কষ্ট আর কাউকে সাহস দেয়, তবে হ্যাঁ… আমি চাই, জানুক সবাই।”


রায়হান ওর হাত ধরে,

— “তাহলে রাজি হয়ে যাও। আমি পাশে আছি সবসময়।”


---


দৈনিক যুগধ্বনির প্রথম পাতায় নাদিয়ার মুখ—বড় করে লেখা “একজন নাদিয়ার গল্প”। নিচে সাবহেডলাইন:

**“ধর্ষণের শিকার, কিন্তু ভেঙে না পড়ে লড়েছেন, বিচার ছিনিয়ে এনেছেন। সমাজের কলঙ্ক নয়, তিনি আজ প্রেরণা।”**


সেই দিন থেকে বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু। নারীরা ফেসবুকে শেয়ার করে আর বলে,

— “আমরা সবাই নাদিয়া।”


গ্রামের কলেজের ছাত্রী রূপা এসে বলে,

— “আপা, আপনি আমার হিরো। আমি আপনাকে দেখে সাহস পাই।”

— “তুমি নিজের ভেতরে সেই সাহস খুঁজে নাও, রূপা। আমার গল্প শুধু একটা উদাহরণ।”


তবে এর মাঝে কিছু বিষাক্ত কথাও শোনা যায়—

— “এই মেয়েটার কি লজ্জা নেই?”

— “সব সময় মিডিয়ায় নিজেকে দেখায়।”

— “এ তো নাম কামানোর একটা পদ্ধতি পেয়েছে।”


রায়হান এসব শুনে রাগ হয়, কিন্তু নাদিয়া শুধু একবার হাসে।

— “তারা বোঝে না। তাদের বোঝার চোখ নেই।”


---


দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়। নাদিয়ার ছেলে এখন হাঁটতে শেখে, "মা মা" বলে ডাকে।


একদিন হঠাৎ করেই রায়হানের বাবার বড় ভাই, মানে গ্রামের প্রভাবশালী লোক—মজিবর চাচা আসেন বাড়িতে।


— “রায়হান, আমি ভাবছি, তোমাদের শহরে একটা বাসা নিয়ে দেই। এখানে তোমাদের নিয়ে অনেক কথা হয়। এই ছেলে তো তোমার নয়, সবাই জানে। কেন এসব সয়ে যাচ্ছ?”


রায়হান চুপ। মাথা নিচু করে বসে থাকে।


নাদিয়া এগিয়ে আসে। চোখে পানি নেই, কিন্তু কণ্ঠটা কঠিন।


— “চাচা, আপনি চাইলে বাসা কিনে দিতে পারেন। কিন্তু আমি কোথায় থাকব, সেটা আপনি ঠিক করবেন না। আর একটা কথা মনে রাখবেন, এই ছেলে শুধু আমার নয়, রায়হানেরও।”


চাচা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। রায়হান এবার বলে,

— “চাচা, সন্তান রক্তের না হোক, ভালোবাসার তো হয়। আমি এই ছেলেকে বাবা হিসেবেই বড় করব। সে আমার গর্ব।”


মজিবর চাচা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তিনি উঠে বলেন,

— “আজকাল মেয়েদের মুখের জোর বেড়েছে। ভালোই। তবে সময়ই সব ঠিক করবে।”

চলে যান, আর ফেরেন না।


---


একদিন রাতে রায়হান নাদিয়াকে বলে,

— “তোমার গল্প নিয়ে একটা বই বের করতে চাই। তুমি লিখবে?”

নাদিয়া বলে,

— “তুমি লিখো, আমি বলি।”

— “চলো তবে, শুরু করি। নাম কী রাখবো?”

— “হতভাগা।”


রায়হান বিস্মিত হয়,

— “এই নাম?”

— “হ্যাঁ। কারণ প্রথম দিন থেকেই সবাই আমায় এই নামে ডেকেছে। এবার আমি এই নামকেই গর্বে পরিণত করবো।”


---


বই প্রকাশিত হয় ৬ মাস পরে। সাহিত্য মেলায় সেই বইয়ের স্টলে ভিড়—"হতভাগা: এক সাহসিনীর কাহিনি"। অনেকেই অটোগ্রাফ নেয়। কিছু লোক কাঁদে, কিছু হাসে, কিছু মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ বলে,

— “আপনি শুধু লেখক না, আপনি যোদ্ধা।”


এমন সময় স্টলে আসে এক যুবক, তার চোখে কান্না, কণ্ঠ কাঁপা।

— “আপনি যদি আমার বোন হতেন, তাহলে আমি গর্ব করতাম। আমি আপনার মতো একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।”


নাদিয়া বলে,

— “তুমি পাশে থাকো, যাতে আর কোনো মেয়ে একা না পড়ে।”


---


এক সন্ধ্যায়, রায়হান ঘরে এসে দেখে নাদিয়া ছেলের হাতে একটা ছোট খেলনার গাড়ি দিয়ে বলছে,

— “জানো, বাবা একসময় তোমার জন্য একটা আসল গাড়ি কিনবে।”

ছেলেটা হাসে। ছোট্ট দাঁতগুলো ঝিলমিল করে।


রায়হান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবে,

— “এই দুই প্রাণই এখন তার পৃথিবী। এই দুইজনই তাকে মানুষ করে দিচ্ছে। দায়িত্বশীল করে তুলেছে।”


সে ধীরে ধীরে এসে বলে,

— “আমি তোমাদের নিয়ে আরও কিছু করতে চাই। চাই, ‘হতভাগা’ নামে একটা সংগঠন গড়ি—যেখানে নির্যাতিত মেয়েরা কথা বলবে, লড়বে, নিজেদের মতো করে বাঁচবে।”


নাদিয়া বলে,

— “তোমার ভাবনাটা আমার নিজের মতো মনে হচ্ছে।”


তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কাজ শুরু হবে আগামী মাস থেকে। গ্রামের পাশেই একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া নেয়, যেখানে একটি সেল্টার হোম আর কাউন্সেলিং সেন্টার গড়ে তোলা হবে।


---


**শেষাংশে…**


সন্ধ্যা নামছে। আকাশ লালচে রঙ ছুঁয়ে নিচে নেমে আসছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। ঠিক তখনই, নাদিয়া বারান্দায় বসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে,


— “শোনো, বাবু, আমি একদিন হতভাগা ছিলাম। সবাই সেই নামে ডাকত। কিন্তু আজ আমি একজন মা, একজন যোদ্ধা, একজন পথপ্রদর্শক। তুমি একদিন জানবে, তুই আমার সমস্ত হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে এনেছিস। আমি গর্ব করি তোর জন্য। আমি গর্ব করি আমার জীবনের জন্য।”


ছেলেটা হাত বাড়িয়ে বলে,

— “মা… মা…”


নাদিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি, এক গভীর আত্মবিশ্বাস। সে জানে, জীবন তাকে ভেঙে ফেলতে পারেনি। সে জানে, এখন কেউ তাকে **“হতভাগা”** বললে সে গর্ব করে মাথা তুলে বলবে—

**“হ্যাঁ, আমি সেই হতভাগা, যে হার মানেনি।”**


---


**চলবে…

 পর্ব: ৪

গল্প: হতভাগা

লেখক: গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মদ

💝হতভাগা গল্পটি সম্পন্ন pdf নিতে চান তাহলে এ নাম্বার 01897682335 হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমু করুন নাহলে পেইজে ইনবক্স করুন।

⭕শত্য প্রযোজ্য।